বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী, কিন্তু তাঁহার সন্ন্যাস-ধর্ম নিষ্ক্রিয় আত্মোপলব্ধির কথা বলিত না। সন্ন্যাসীদের জন্য তিনি যে ‘মিশন’ নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন তাহা কর্মের। দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষদের সহায়তা করিতে হইবে। প্লেগে, দারিদ্রে, দুর্ভিক্ষে তাঁহার সহযাত্রী সন্ন্যাসীরা সাধারণের পার্শ্বে ছিলেন। নিতান্ত বাহির হইতে সহায়তা নহে, ভিতর হইতে যোগসাধন আবশ্যক। বিবেকানন্দ সহায়তার পরিবর্তে ‘সেবা’ ও ‘প্রেম’ শব্দ দুইটি ব্যবহার করিয়াছিলেন। জীবে প্রেম। জীবে সেবা। সহায়তার চাহিতে ‘সেবা’ ও ‘প্রেম’ অর্থে গভীরতর। যিনি সেবা করিতেছেন ও যাঁহাকে সেবা করা হইতেছে, উভয়েই সমান। প্রেমময় সন্ন্যাসীর সমানুভূতি বিবেকানন্দের কাম্য। সাধারণ অসহায় মানুষদের কেবল দ্রব্যাদি প্রদান করিলে চলিবে না, তাঁহাদের শিক্ষা প্রদান করিতে হইবে, অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে। এই দিক হইতে বিচার করিলে বিবেকানন্দ যে কর্মের ‘মিশন’ রাখিয়াছিলেন তাহা সুদূরপ্রসারী।
বিবেকানন্দ গৃহীদেরও কর্মের ভার দিয়াছিলেন। সন্ন্যাসীরা নিষ্কামচিত্তে অসহায় জনসাধারণকে সমর্থ করিয়া তুলিবেন, সমর্থ গৃহীরা পরিবার ও দেশের জন্য আত্মনিয়োগ করিবেন। বিবেকানন্দের অনুরাগী ছিলেন জামসেদজি টাটা। শিকাগো যাত্রাকালে জাহাজে বিবেকানন্দ তাঁহার সহিত কথোপকথনকালে শিল্পের সহিত বিজ্ঞানের যোগ সাধনের কথা বলিয়াছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এক পত্রে জামসেদজি বিবেকানন্দকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। বিবেকানন্দের ‘কর্মযোগ’ নামের বক্তৃতা-নিবন্ধে গৃহধর্মের কথা রহিয়াছে। শিক্ষার্জন, উপার্জন, এই দুইটি গৃহীর দায়িত্ব। উপার্জনক্ষম গৃহী পরিবার, সমাজ ও দেশের অন্যান্য মানুষদের সহায়তা করিবেন। বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী ও গৃহী উভয়কেই বাস্তবসম্মত কর্মের দায়িত্ব দিয়াছিলেন। কর্মহীন পলায়নবাদী জীবনধর্মের তিনি সমালোচক। বাঙালির চরিত্রে পলায়নবাদের প্রাবল্য বহুনিন্দিত। পলায়নের জন্য বাঙালি অনেক সময় দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদির অছিলা ব্যবহার করে। বিবেকানন্দ স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছিলেন, যে দর্শন মানসিক কসরত হইয়াই থাকে, তিনি তাহার পক্ষপাতী নহেন। তাঁহার ধর্ম ‘প্র্যাকটিকাল বেদান্ত’। নিষ্ক্রিয় তামসিকের গীতাপাঠের চাহিতে কর্মময় রাজসিকের ফুটবল খেলা তাঁহার নিকট গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দা কথা, কী সন্ন্যাসী কী গৃহী সকলকেই কাজ করিতে হইবে। সকলের জন্য, সমবেত ভাবে।
পরাধীন ভারতবর্ষে যে কথাগুলি সত্য ছিল, স্বাধীন বিশ্বায়িত ভারতেও সেই কথাগুলি সত্য। বিবেকানন্দ ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, পীত জাতির উত্থান হইবে। যখন বলিয়াছিলেন তখন চিন সম্পর্কে কেহ উচ্চাশা পোষণ করিত না। তাঁহার বাণী ফলিয়াছে। চিন কর্মযোগে দুনিয়া মাত করিয়াছে। পীত অথবা শ্বেত, লাল অথবা সবুজ রং যাহাই হউক, কর্মের বিকল্প নাই। সমাজ ও দেশের প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষে পলায়নবাদী বঙ্গজরা কথাটি বুঝিলেই ভাল। |