|
|
|
|
আগামীতে মোদী দেশনেতাই, বুঝিয়ে দিল গুজরাত
জয়ন্ত ঘোষাল • গাঁধীনগর |
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, অর্থনীতি যদি ভিত হয়, তারই উপরে গড়ে ওঠে রাজনীতির সৌধ।
গুজরাতের নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী নিজে মার্কসবাদ-বিরোধী হলেও আজকের শিল্প সম্মেলনকে বিনিয়োগ মঞ্চ থেকে জাতীয় রাজনীতির সৌধে পৌঁছে দিলেন অনায়াসে। মোহন ভাগবত অথবা নিতিন গডকড়ী চান আর না চান, আন্তর্জাতিক দুনিয়া আর দেশের শিল্পপতি মহল যে ৬১ বছর বয়সী নরেন্দ্র মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ভাবছে, তা আজ কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
গাঁধীনগরের মহাত্মা মন্দিরের বিশাল প্রান্তরে রতন টাটা থেকে মুকেশ অম্বানী, অনিল অম্বানী থেকে আদি গোদরেজ সবাই গুজরাতের উন্নয়নের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত থাকলেন না। সেই উন্নয়নের স্থপতি নরেন্দ্র মোদীরও ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আর তা থেকেই স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হ্যাটট্রিক করার পর এ বার সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে মোদীকে দেখতে চাইছেন অনেকেই। রাশিয়ার এক প্রভিন্সের কূটনীতিক মার্ক ইলোভ তো বলেই বসলেন, নরেন্দ্র মোদী ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এ বার সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য লড়বেন। ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত বললেন, মোদী শুধু গুজরাতে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। তাঁকে দেশের কাজে প্রয়োজন।
শিল্পপতি, রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার মানুষের আগমন। আনন্দ মহীন্দ্রা, অনিল অগ্রবাল, বেণুগোপাল ধুত, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, বাবা কল্যাণী কে নেই! আজ রতন টাটা আসার পর আগামিকাল সাইরাস মিস্ত্রিও আসবেন। এমনকী নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তানের আক্রমণ নিয়ে যখন এত বিতর্ক চলছে, সেই সময় করাচি থেকেও একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল এসেছে। কচ্ছে বন্দর এলাকায় কাজ করতে চায়
তারা। মোদী তাঁদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকও করেছেন। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তাঁদের বুলেটপ্রুফ গাড়িও দেওয়া হয়েছে।
এমন নয়, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন বলেই মোদী আজ আকস্মিক ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ সম্মেলন করছেন। ২০০৩ সালে শুরু হয়েছিল এই সম্মেলন। তখন কিন্তু দাঙ্গার পটভূমি। সে বার মউ স্বাক্ষর হয়েছিল ৭৬টি। আজ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৩৮০ টি। দু’বছর অন্তর সম্মেলন হয়। ২০০৩ সালে যখন শুরু হয়েছিল, সেদিন এর পিছনে বিনিয়োগ ছিল ৬৬ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। আর আজ সেটা ২০ লক্ষ ৮৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। গুজরাতের সম্মেলন আক্ষরিক অর্থেই ‘ভাইব্র্যান্ট’, চনমনে!
ব্রিটেনের হাইকমিশনার জেমস ডেভান যদিও বলেছেন, ব্রিটেন ২০০২ সালের দাঙ্গার কথা ভোলেনি। দাঙ্গাপীড়িতরা ন্যায়বিচার পান, সেটাই চান তিনি। কিন্তু আজকের সম্মেলনে উপস্থিত থেকে জেমস যে ভাষায় গুজরাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করলেন, তা থেকে স্পষ্ট, বয়কটের নীতি থেকে সরে আসছেন তাঁরা। জেমস বললেন, চিনের থেকে গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধির হার যে বেশি, সেটা বাস্তব। চিন ও জাপানের রাষ্ট্রদূতরাও কিন্তু সম্মেলনে হাজির। ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ফ্রেডি সোয়েন নিজে অস্ট্রেলিয়া ও স্পেনের রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের হাইকমিশনারকে বুঝিয়েছেন, গুজরাতের উপর থেকে বয়কট যেন তুলে নেওয়া হয়। সম্প্রতি মোদী যখন দিল্লি গেলেন, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত রাষ্ট্রদূত তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন। তার পর থেকে ব্রিটেনও আমেরিকাকে বোঝাচ্ছে, যাতে বয়কটের পথ থেকে সরে আসে তারা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে আসেননি ঠিকই। কিন্তু ইন্দো-মার্কিন বাণিজ্য দল, আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা এসেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে সবথেকে নজর-কাড়া মন্তব্যটি করলেন অনিল অম্বানী। বললেন, গুজরাত নির্মাণের কারিগর আসলে চার জন। প্রথম জন ১৮৬৯ সালে ২ অক্টোবর পোরবন্দরে জন্ম নিয়েছেন। গাঁধী। তার পর পটেল জন্ম নিয়েছেন ১৮৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর। ধীরুভাই অম্বানীর জন্ম ১৯৩২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তার পরেই ১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। গাঁধী বলেছিলেন, তত্ত্ব ও প্রয়োগের দ্বন্দ্বের কথা। পটেল বলেছিলেন আত্মত্যাগের কথা। ধীরুভাই অম্বানী বলেছিলেন, স্বপ্ন দেখে সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে। মোদী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে এই সব লক্ষণই রয়েছে। অনিল অম্বানীর কথায়, মোদীর লক্ষ্য অর্জুনের মতো। উন্নয়নই তাঁর পাখির চোখ। অতীতে এই মঞ্চেই অনিল এক বার বলেছিলেন, দেশের নেতা হতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। এ বারে অত সরাসরি কোনও মন্তব্য না করেও নিজের মনোভাবটি আরও এক বার বুঝিয়ে দিলেন তিনি। অনিলের দাদা, মুকেশ অম্বানীও বললেন, “গুজরাতি হিসাবে আমি গর্ববোধ করি। গুজরাত হচ্ছে ভারত ও দুনিয়ার মিশেল।”
চার দিক থেকে এত প্রশংসার বন্যা! খোদ মোদী কী বলছেন? “এক সময় গুজরাত ছিল গোটা দুনিয়ার দরজা, গেটওয়ে। আর এখন আমার লক্ষ্য, গোটা দুনিয়ার আশ্রয় যেন হতে পারে এই গুজরাত।” কোথাও গোধরা বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছেন না। মানসিকতা বদল বা নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মোদীর দিক থেকে কোনও তাড়াহুড়োই চোখে পড়ছে না। তাঁর লক্ষ্য শুধু শিল্প ও উন্নয়ন।
ভদনগরের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন মোদী। যে গ্রামের উল্লেখ রয়েছে আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরে। গ্রামের শর্মিষ্ঠা হ্রদেই স্নান করতেন। দেহাতি পরিবারের সেই সন্তান মোদীই এখন এক রাজসূয় যজ্ঞের পুরোহিত। এই ব্যস্ততার মধ্যে কী ভাবে অবসর কাটান? মোদীর জবাব, প্রতি রাতে ‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে জে..’ গানটি শোনেন। তার পর ঘুমোতে যান। “আজ যেখানে এই শিল্প সম্মেলন হচ্ছে, সেটিও মহাত্মার মন্দির। এই সম্মেলন আয়োজনের এটিই শ্রেষ্ঠস্থল।” গাঁধী-জীবনী নিয়ে একটি প্রদর্শনীও আয়োজন করা হয়েছে। সেটিও সকলকে ঘুরে দেখাচ্ছেন মোদী।
গাঁধী, অহিংসা আর উন্নয়ন, এটাই এখন তাঁর মন্ত্র। |
|
|
|
|
|