কলকাতা বদলে গেলে কি বাঙালি বদলে যায়? নাকি বাঙালি বদলে গেলে কলকাতা বদলে যায়? এই রদবদলের রিমোট কন্ট্রোলটা কার হাতে?
বাঙালি মানেই কি কলকাতা? নাকি কলকাতা মানেই বাঙালি? ডেমোগ্রাফির বাঁক-বদল কোন দিকে যাচ্ছে?
খুব সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নপত্রটা?
ঘাবড়াবেন না, ‘মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর’ নিয়ে লিখতে বসে প্রশ্নগুলো রাখলাম বটে! ছবিটা কিন্তু বদলে যাওয়া কলকাতা আর বাঙালিকে সেলিব্রেট করতে বসে আদপেই কোনও জ্ঞানগর্ভ সমাজ-বিশ্লেষণের দিকে যায়নি। বরং প্রচুর মজা, অজস্র মিচকে সংলাপ আর বেশ কয়েকটা মনে রাখার মতো মুহূর্ত তৈরি করেছে।
একটা পরিবারের গল্পে তিন-তিনটে প্রজন্মের চরিত্র থাকবে, জেনারেশন গ্যাপ থাকবে, বাঙালিয়ানা-কলকাতা ইত্যাদি নিয়ে নস্টালজিয়া থাকবে, বদলে যাওয়া সময়ের কথা থাকবে, অথচ ভ্যালু জাজমেন্ট থাকবে না কাজটা কঠিন। আহা কী সব ছিল আর এখন কোন রসাতলে যাচ্ছে, এ রকম কোনও অবস্থান যে মৈনাক ভৌমিক নেবেন না, সেটা জানাই ছিল। তবে নতুনের জয়পতাকা ওড়াতে গিয়ে পুরনোর সঙ্গে ব্যালান্সটা ঠিক কোন মাপতোল মেনে এগোবে, সেটাই ছিল কৌতূহল। মৈনাক সেটায় ভালই উতরেছেন। |
ছবির গল্পটা ‘আজকালকার ছেলেমেয়েদের’ই। কিন্তু শেকড়বাকড়হীন নিরালম্ব নয়। তাদের বাবা-মা আছেন (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, অনুরাধা রায়)। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের ঠোকাঠুকি আছে। আবার বাবা-মায়ের প্রতি মান্যিগণ্যিও আছে। সবচেয়ে বড় কথা ঠাকুরদা আছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এ ছবির অন্যতম চরিত্র। পোশাকে-আশাকে, চিন্তা-চেতনায় সবচেয়ে নবীন, মুক্ত মনের মানুষটি। অতএব কেতাবি ভাষায় যাকে পারিবারিক পরিমণ্ডল বলে, সেটা এ ছবিতে ভরপুর। মৈনাকের আগের ছবি ‘বেডরুম-এ’ এই উপাদানটি কিছুটা অনুপস্থিত ছিল। সে ক্ষতি এ বারে তিনি পূরণ করে দিয়েছেন। ‘মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর’ মোটের উপর তিন ভাইয়ের গল্প। বড় সৌভিক বিবাহিত। আমেরিকার চাকরি ছেড়ে বউকে (স্বস্তিকা) নিয়ে কলকাতা চলে আসে রেস্তোরাঁ খুলবে বলে। মেজো পরমব্রত, একটি মারোয়াড়ি মেয়ের সঙ্গে প্রেম। বিয়ে হব-হব। কিন্তু মারোয়াড়ি শ্বশুরের উপযুক্ত জামাই হয়ে উঠতে পারবে কি না, উঠতে চায়ও কি না, ঠিক বুঝতে পারে না। ডিসিশন নিতেও ধ্যাড়ায়, না-নিতেও ধ্যাড়ায়। আপাদমস্তক আমতা-আমতা এই চরিত্রটায় পরম বড় ভাল অভিনয় করেছেন।
ছোট ছেলে অনুব্রত, সে অভিনেতা হওয়ার চেষ্টায় আছে। এক্সিসটিং গার্লফ্রেন্ডদের বিদেয় করেছে। মেজদার মারোয়াড়ি কানেকশন নিয়ে চিমটি কাটে। বউদিকে ভালবাসে। মাঝেমধ্যে লেঙ্গি মারার মেডইজি নিয়ে মেজদাকে জ্ঞান-ট্যানও দেয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার নিজেরই একটি অবাঙালি বান্ধবী (নেহা) হয়। ছোট ছেলের গল্পটা আলাদা প্যারাগ্রাফে লিখছি কেন, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। সিম্পল। অনুব্রত একটা গোটা প্যারাগ্রাফ দাবি করছেন। সবচেয়ে মজাদার চরিত্র, সবচেয়ে নজর-কাড়া অভিনয়। আজ্ঞে! ম্যাডলি বাঙালি, গান্ডু, বেডরুম, ছত্রাক-ক্লিপিংঅনুব্রতকে নিয়ে যাবতীয় এক্সপিরিয়েন্স জাস্ট ভুলে যান! এই ছবিতে ওঁর অভিনয়টা শুধু দেখতে হবে। কোনও রকম সাহসী দৃশ্য-টিশ্য ছাড়াই। একটা ফোনের সিন আছে অনুব্রত এক বাড়ির মালকিনকে একটা ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য কনভিন্স করার চেষ্টা করছেন। অনুব্রতকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন!
আরও দু’টি ফাটাফাটি আবিষ্কার আছে। নেহা আর অজপা। স্টাইলিস্টরা যদি এত ভাল অভিনয় করেন, তা হলে কিন্তু অভিনেত্রীদের সামনে বিপদ আসছে! জোকস অ্যাপার্ট! নেহা তো আগেই বলেছি, অনুব্রতর বান্ধবীর চরিত্রে। দারুণ ইন্টারেস্টিং দেখতে, স্ক্রিন প্রেজেন্সও দারুণ! নেহার কোমর জড়িয়ে বাইকের পিছনের সিটে অনুব্রত গোটা হল উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠল! অজপা বাস্তবেও স্বস্তিকার বোন, পর্দাতেও। দুই বোনের নিজস্ব কেমিস্ট্রি তো আছেই। প্লাস এ ছবির সবচেয়ে প্রিটেনশনলেস চরিত্রটা পেয়ে অজপা একদম ফাটিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু ঝুলিয়েছেন আর এক আবিষ্কার, সৌভিক। এত বড় একটা চরিত্র টানতেই পারেননি। স্বস্তিকার সঙ্গে মানায়ওনি। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার জায়গাগুলোতে স্বস্তিকা খুব ভাল অভিনয় করেছেন। কিন্তু সহ-অভিনেতা এত দুর্বল হলে তিনি কী করবেন? গল্পের লজিকটাই মার খেয়ে যাচ্ছে তো! স্বস্তিকার মতো এক জন স্ত্রী কেন সৌভিকের মতো এক জন আনইম্প্রেসিভ স্বামীকে নিয়েই শুধু বাঁচেন, সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না! তিনি আমেরিকাতেও হাউসওয়াইফ ছিলেন, এখানেও তাই থাকলেন। মা হবেন কি হবেন না, ভাবতে থাকলেন! ব্যস? একই কথা রাইমা সম্পর্কেও। রানঅ্যাওয়ে ব্রাইড। নিজেই বলছেন, ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসে স্ট্রেস কাটানোর ক্লাস নিচ্ছিলেন! আমতা-আমতা পরমের প্রেমে পড়ে গেলেন!
এবং এইখানেই পরিচালক মশাইয়ের জন্য সত্যি সত্যি সিরিয়াস কিছু প্রশ্ন জমা হচ্ছে। বেশ কিছু দৃশ্যে আপনার সংলাপ লেখার ক্ষমতা দেখে চমকে গেলাম। বেশ কিছু মুহূর্ত মনে দাগ কেটে গেল। কিন্তু সব মিলিয়ে আপনি ঠিক কী বলতে চাইলেন গোটা ছবিটা জুড়ে? মূল তিনটে চরিত্র, যারা নিজের নিজের মতো করে নিজেদের লভ লাইফ নিয়ে নড়বড় করছিল, তারা ছবির শেষে খাপে খাপে মিলে গেল এটাই? আর তার সঙ্গে একটু আত্ম-আবিষ্কার টাইপ অ্যাঙ্গল জুড়ে দিয়ে সৌভিক চাকরি করবে না রেস্তোরাঁ খুলবে, পরম চাকরি করবে না মারোয়াড়ি পার্টনারশিপে যাবে ইত্যাদি প্রভৃতি প্রশ্ন? মা গো, সেটা বললেই হত! তার সঙ্গে বদলতা হুয়া কলকাতা-বাঙালিটাঙালি বলে একটা লার্জার ক্যানভাস দেওয়ার চেষ্টাটা আদৌ দরকার ছিল? এই তথাকথিত বদলের যুগে গপ্পে বেসিক কোনও বদল এল না তো! প্রেম আর পেশা নির্বাচন কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির যাবতীয় কনফিউশন আর ক্রাইসিস কি এখানেই শেষ? যদি তা-ও হয়, সেগুলোও আল্টিমেটলি এত নিরীহ, নির্বিষ? এত সুপারফিশিয়াল? এত প্রেডিক্টেবল? না বোধহয়! ‘অ্যান্ড মোর’-এর ‘মোর’টা গেল কোথায়? সময়ের বদল তাতে ঠিক কী ভূমিকা নিল, বোঝা গেল না।
মোর-এর খানিকটা অবশ্য পাবেন গানে। ঋতুপর্ণ ঘোষ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়রা এ ছবির গানে কলম ধরেছেন। নীল দত্তের সুরে গানগুলো শুনতে বেশ ভাল লাগে।
খানিকটা পাবেন সৌমিত্রয়। কী অনায়াসে পর্দায় ভরাট হয়ে ওঠেন যে তিনি! নইলে পার্নো-র গল্পটায় কী বা ছিল বলার মতো?
একটা নেগেটিভ ‘মোর’-ও আছে। ছবিটা আরও কিছুটা ছোট হলে ভাল হত! সামটাইমস লেস ইজ মোর! |