নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গত ক’দিন ধরে এমনিতেই উত্তেজনা যথেষ্ট। তাতে ইন্ধন জোগাল লস্কর-ই-তইবার প্রধান হাফিজ সঈদের হুমকি। ভারতীয় সেনার উপর পাক সেনার সাম্প্রতিক হামলায় হাফিজের হাত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছিলেন না গোয়েন্দারা। সেই হাফিজই আজ ‘কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশ কিছু দিন ধরে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ২৬/১১-র মূল ষড়যন্ত্রী হাফিজ। ভারতীয় জওয়ানদের মাথা কাটার পিছনে তাঁর প্ররোচনা আছে কি না, তা এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্বভাবতই নয়াদিল্লির সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে হাফিজ পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন ভারতই পাকিস্তানে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে। তাই কাশ্মীরের হিংসা আরও জঘন্য চেহারা নিতে পারে।
হাফিজ যখন এই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, তখন ভারত-পাক কূটনৈতিক চাপানউতোরও অব্যাহত। আজ ইসলামাবাদে পাক বিদেশ মন্ত্রকে ভারতীয় হাইকমিশনার শরৎ সভ্রওয়ালকে ডেকে পাঠানো হয়। গতকাল বাট্টাল সেক্টরে ভারতীয় জওয়ানদের গুলিতে এক পাক সেনার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করে তাঁর কাছে লিখিত অভিযোগ (ডিমার্শ) করেন পাক বিদেশসচিব জলিল আব্বাস জিলানি। ভারতের তরফেও জানিয়ে দেওয়া হয়, মেন্ধার সেক্টরে পাকিস্তানের দিক থেকে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানো হয়েছিল। তারই নিয়ন্ত্রিত জবাব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার গোপাল বাগলেকে ডেকে পাঠিয়ে পাকিস্তান অভিযোগ করেছিল, গত রবিবার উরি সেক্টরে ভারতীয় সেনা গুলি চালিয়েছে। দুই জওয়ানের হত্যাকাণ্ডের পর একই ভাবে দিল্লিতে পাক হাইকমিশনার সলমন বশিরকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ভারতের তরফে আজও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখার অলঙ্ঘনীয়তা রক্ষা জরুরি। শান্তি চুক্তি মেনে চলতে হবে। কারণ নিয়ন্ত্রণরেখাই হল দু’দেশের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আস্থাবর্ধক বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের দিক থেকে গত পাঁচ দিনে তিন বার শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে। পুঞ্চ সেক্টরের তিনটি জায়গায় গুলি চলেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রপুঞ্জের সামরিক নজরদারি গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ চাইলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা শিমলা চুক্তি মেনে দ্বিপাক্ষিক স্তরেই সমস্যার সমাধান করতে চান। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মেটানোর আহ্বান জানিয়েছে বেজিংও।
এ দিকে, দু’দেশের কূটনৈতিক পাঞ্জার মধ্যে পড়ে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ব্যবসা-বাণিজ্য দু’দিন ধরে বন্ধ। এ দিক থেকে পাকিস্তানের দিকে ফল ও শাকসব্জি নিয়ে যাওয়া ট্রাকগুলি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কারণ, নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তান ফটক খুলছে না। ট্রাকের সারির পিছনে আটকে গিয়েছে পুঞ্চ থেকে রাওয়ালকোট যাওয়ার বাসও। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। স্থানীয় স্তরে কথাবার্তা বলে বিষয়টি মিটমাটের চেষ্টা হচ্ছে।
গত কাল পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার আশা প্রকাশ করেছিলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় দু’দেশের মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়ায় কোনও ধাক্কা লাগবে না। কিন্তু তিনি যা-ই বলুন, পাক সেনার আগ্রাসী মনোভাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখছে দিল্লি। কারণ, ঘরোয়া রাজনীতিতেও বিষয়টি যথেষ্ট স্পর্শকাতর। বিজেপি নেতা যশবন্ত সিন্হা আজ পাকিস্তানের সঙ্গে সব রকম আলাপ-আলোচনা বন্ধের দাবি তুলেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিও এ বারের শান্তি চুক্তি লঙ্ঘনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, “গত এক বছর ধরেই শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন বাড়ছে। তাই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের। কাশ্মীরে হিংসাত্মক ঘটনা কমলেও নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অনুপ্রবেশের চেষ্টা বেড়েছে। দেশের ও জওয়ানদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব রকম পদক্ষেপ করা হবে। দু’দেশের ডিজি (মিলিটারি অপারেশন্স) নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন।”
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় রাজৌরিতে ২৫ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সদর দফতরে আলোচনায় বসেন সেনাকর্তারা। মেন্ধার সেক্টরে দুই বাহিনীর কম্যান্ডারদের মধ্যে ফ্ল্যাগ-মিটিংয়ের ডাক দেওয়া হয়েছে। শীতকালে কুয়াশার মধ্যে নজরদারির জন্য বিএসএফের তরফেও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন প্রতিরক্ষাসচিব শশীকান্ত শর্মা। |