তিনি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে জামা ওড়াতেন। টিমমেটের পাশে দাঁড়িয়ে আইসিসি-র রোষানলে পড়ে নিজেই নির্বাসনের শাস্তিভোগ করতেন। ম্যাচে তো বটেই, প্র্যাক্টিসেও পুরো টিমকে ডেকে নিয়ে ক্লাস বসত। কথায়-কথায় ‘হাডল’।
ইনি আগলখোলা উৎসবের জোয়ারে কোনও দিনই ভাসেন না। বিশ্বকাপ জিতলে বড়জোড় একবার হাতের ব্যাট ঘোরে, ঠোঁটে ঝোলে চিলতে হাসি। ‘হাডল’ থিওরিতে বিশেষ বিশ্বাস নেই। টিম থাকে টিমের মতো, তিনি তাঁর মতো। বৃহস্পতিবারের রাজকোটেও কিছু পাল্টালো কি? যুবরাজ সিংহ, গৌতম গম্ভীররা যে যার মতো নেটে। তিনি ঢুকে অন্য একটায়। নিজ-মনে ঝালিয়ে নিচ্ছেন ব্যাটিং-পাঠ। এক বার, দু’বার...।
প্রথম জন চরমতম অন্ধকূপ থেকে রেনেসাঁর সন্ধান দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটকে। জন্ম দিয়েছিলেন এমন এক টিম থিমের, যা ঢুকে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথায়।
অন্য জন নিজেই অন্ধকূপে বন্দি। দেশজুড়ে চলছে তাঁর স্ট্র্যাটেজির মুন্ডুপাত। টিম কাঠগড়ায়। পূর্বসুরির মতো তিনি বন্দিত নন। নিন্দিত।
তবু কোথাও যেন আজ মিলে যাচ্ছেন এই দু’জন। মিলে যাচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আধিনায়ক হিসেবে দু’জনে দুই পৃথিবীর, কিন্তু ২০১৩-র রাজকোট ক্যাপ্টেন কুলকে একই অবস্থানে পৌঁছে দিচ্ছে অদূর অতীতের আর এক ভারত অধিনায়কের সঙ্গে। ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির সঙ্গে! সন্ধিক্ষণটাই এমন। তেরো বছরের পুরনো প্রেক্ষাপটে না ফিরে উপায় কী? |
ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে সৌরভের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল অধিনায়কত্বের ‘কাঁটার মুকুট’। শুধু তো ম্যাচ গড়াপেটার কালো ছায়ায় নষ্ট হয়ে যাওয়া টিমের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা নয়। কাজটা ছিল আরও কঠিন। ভারতীয় ক্রিকেটাররা দেশে বাঘ আর বিদেশে বেড়াল সৌরভকে লড়তে হয়েছিল ক্রিকেটবিশ্বের মননে গেঁথে যাওয়া সেই ধারণার বিরুদ্ধেও। ভারতীয় দলকে সেই অতলস্পর্শী ‘ব্ল্যাক হোল’ থেকে টেনে তুলেছিলেন সৌরভ। তাঁর হাতেই সযত্নে তৈরি ভারতীয় ক্রিকেট দলের আজকের পরিচয় টিম ইন্ডিয়া। নীল জার্সির অতিপরিচিত ‘হাডল’-এর যিনি জন্মদাতা।
২০১৩-এ পা দেওয়া টিম ইন্ডিয়া তেমনই আর একটা কালো গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার পথে। খাঁটি ক্রিকেটীয় ‘ব্ল্যাক হোল’ যাকে বলে। আর বারো বছর আগে সৌরভ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আজকের ধোনির অবস্থানটাও যেন ঠিক সে রকম। হাতে প্রায় আনকোরা একটা টিম। সচিন তেন্ডুলকর, জাহির খান, হরভজন সিংহকেউ নেই। ওপেনিংয়েও বীরুর থেঁতলানিও অনির্দিষ্টকালের জন্য অতীত। সিনিয়র বলতে হাতে গোনা তিন। গম্ভীর, যুবরাজ আর ধোনি নিজে।
খুব সহজে, যতই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পঞ্চাশ ওভারের যুদ্ধ হোক, রাজকোটে শুক্রবার শুরু ধোনির আসল লড়াইটা অন্য। ‘ট্রানজিশন পিরিয়ডে’র মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটা দলকে তার নতুন পরিচয় দেওয়ার লড়াই। পা পিছলে পড়া টিম ইন্ডিয়াকে সঞ্জীবনী মন্ত্রের সন্ধান দেওয়ার লড়াই।
অনেকটা গাঙ্গুলির মতো!
যে লড়াইয়ের মুখে অবিচল অধিনায়ক। শুধু তো টিম নয়, ক্যাপ্টেন কুলের নিজ-ক্ষমতা, অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্নের বন্যা দেশে, বিদেশে। বৃহস্পতিবারের বারবেলাতেও চলল একদফা। ধোনিকে প্রশ্ন করা হললাগাতার হারে নিজের ক্ষমতার উপর কি এখন বিশ্বাস হারাচ্ছেন? উত্তর হিমশীতল, “নিজের ক্ষমতা নিয়ে আমি কোনও দিন প্রশ্ন তুলি না। এগুলো তো দুর্বল লোকেরা করে থাকে। বাকিরা তোমায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তুমি নিজে করলে আত্মবিশ্বাস বলে কিছু থাকবে না।”
শুনতে ভাল লাগবে। কিন্তু বাস্তব বড় রুক্ষ জমি। ধোনি যতই বলুন, “কোটলার জয় অনেকটাই স্বস্তি দিচ্ছে। ও রকম লো স্কোরিং ম্যাচ জেতা সব সময় স্পেশ্যাল,” ঘটনা হল দিল্লি-দরবারে পাকিস্তান-বধ খুব বেশি হলে মুমূর্ষু ভারতীয় ক্রিকেটের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলেছে। সম্পূর্ণ আরোগ্যের এখনও দেরি। আর এখানেই শেষ নয়। টিমের মতো ধোনিরও আজ থেকে অগ্নিপরীক্ষা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি কত বড় অধিনায়ক, এ বারই তো বোঝা যাবে। আর কাকতালীয় হলেও সত্যি, সে দিনের সৌরভ আর আজকের ধোনির পাল্টা যুদ্ধে প্রতিপক্ষের নামটাও এক।
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে ঐতিহাসিক জয় দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে গাঙ্গুলি-যুগের জামা ওড়ানো শুরু। আজও সেই ইংল্যান্ড, নাসের হুসেন-অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের বদলে শুধু আ্যালিস্টার কুক, কেভিন পিটারসেন। ‘ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি’ পেরেছিলেন। ‘ক্যাপ্টেন কুল’ পারবেন? |
ধোনিকে দ্রাবিড়-টোটকা |
• একাই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়তে হবে
• টেস্টে দরকারে সতীর্থদের সাহায্য নিতে হবে
• ভারতের টি-টোয়েন্টি দল এবং চেন্নাই সুপারকিংসের নেতৃত্ব ছাড়তে হবে |
|