অবশেষে ‘ভ্যানিশ’। দুষ্ট লোক নহে, একটি দুষ্ট অভ্যাস রেলের ভাড়া না বাড়াইবার অভ্যাস। দীর্ঘ এক দশককাল রেলমন্ত্রীরা ভাড়া বাড়ান নাই। এক জন সাহস করিয়া চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহার পর কী হইল জানেন মুকুল রায়, থুড়ি শ্যামলাল। বর্তমান রেলমন্ত্রী পবন কুমার বনশলের একটি সুবিধা আছে ভাড়া বাড়াইবার সিদ্ধান্ত করিতে তাঁহাকে হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের দিকে তাকাইয়া থাকিতে হয় না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংস্কার কর্মসূচির সহিত সঙ্গতি রাখিতে পারেন। তিনি সুবিধাটি কাজে লাগাইয়াছেন। রেলের সব শ্রেণির ভাড়া বাড়িল। কেন ভাড়া বাড়ানো প্রয়োজন, তাহা মুষ্টিমেয় কিছু প্রাদেশিক রাজনীতিককে বাদ রাখিলে দেশের ১৩০ কোটি মানুষই জানেন। ভাড়া না বাড়ায় গত দুই বৎসরে রেলের মোট ক্ষতির পরিমাণ ২১,০০০ কোটি টাকা, আর ভাড়া না বাড়িলে চলতি অর্থবর্ষে ক্ষতি হইত মোট ২৫,০০০ কোটি টাকা। স্বভাবতই উন্নয়নের ঘরে পড়িয়া আছে রাজনীতি। তাহাতে নেতাদের বিশেষ ক্ষতি নাই তাঁহারা সচরাচর রেলে চড়েন না। যাঁহাদের রেলই ভরসা, তাঁহারা কার্যত প্রাণ হাতে করিয়া রেলে চাপেন। দুর্ঘটনায় প্রাণ যদি না-ও যায়, দুর্গন্ধে অথবা ইঁদুরের আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা যথেষ্ট। রেলের হাতে টাকা থাকিলে হয়তো পরিস্থিতি খানিক ভিন্ন হইতে পারিত। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় পবন কুমার বনশলকে এই দফায় রাজনীতি লইয়া ভাবিতে হয় নাই। তাহাতে রেলের খানিক উন্নতি হইতে পারে, এমন আশা ভিত্তিহীন নহে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ফেসবুকের দেওয়ালে প্রশ্ন করিয়াছেন, ‘রেল দফতরের আর কত টাকা চাই?’ দৃশ্যতই, একাধিক বার রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি এই প্রশ্নের সম্যক উত্তর জানেন না। এই ভাড়াবৃদ্ধির বিরোধিতায় তিনি একই সঙ্গে তাঁহার প্রাক্তন দোসর বিজেপি এবং চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থীদের পার্শ্বে পাইয়াছেন। রাজনীতির বিচিত্র গতি! বাম-বিজেপি সমস্বরে আপত্তি করিয়াছে এমন ‘অসময়ে’ ভাড়া বাড়িল কেন? বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করা হইল না কেন? তাহাদের আপত্তিতে একটি কথা স্পষ্ট ‘বাজেট’ কাহাকে বলে, রাজনীতিকরা ভাল জানেন না। বাজেট বাৎসরিক জমা-খরচের খতিয়ানমাত্র, তাহার আর কোনও মাহাত্ম্য নাই। তাহা বর্ধিত ভাড়া ঘোষণার, নানাবিধ নূতন ট্রেন ঘোষণার মঞ্চ নহে। বাজারে আলু-পটলের দাম বাজেটের অপেক্ষায় বসিয়া থাকে না, সোনার দামও নহে। আদর্শ অবস্থায় পেট্রোল ডিজেলের দামও আলু-পটলের ন্যায় কমিবে-বাড়িবে। রেলের ভাড়াও। রেল চালাইবার খরচ বাড়িলে, উন্নয়নের জন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন পড়িলেই ভাড়া বাড়িবে। সেই ভাড়া বৃদ্ধিতে জমা-খরচের কী হইল, বাজেটের দিন জানা যাইবে, এইমাত্র। বস্তুত, ‘রেল বাজেট’ নামক বাৎসরিক উৎসবটি আদৌ কেন থাকিবে, এই বার সেই প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন। সরকারের সব দফতরই বাজেট তৈরি করে, পেশ করে। অন্য কাহারও এমন ঢাকঢোল পিটিবার প্রয়োজন পড়ে না। রেলেরও প্রয়োজন নাই। নেহাত অভ্যাসের খাতিরে ‘রেল বাজেট’ নামক বাহুল্যটি বজায় রাখিবার আর প্রয়োজন নাই। ভ্যানিশ। |