পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহা এতটাই উদ্বেগজনক যে স্বয়ং রাজ্যপালকেও তাহা লইয়া মন্তব্য করিতে হইয়াছে। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন জঙ্গি হামলা, অগ্নিসংযোগ, বোমা-গুলি ছোঁড়ার ঘটনাকে ‘গুণ্ডারাজ’ আখ্যা দিতেও দ্বিধা করেন নাই। প্রসঙ্গত অনেকেরই মনে পড়িবে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সংঘটিত নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের কথা, যেখানে পুলিশি গুলি-চালনায় ১৪ জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জানাইতে গিয়া তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী সরব হইয়াছিলেন। দুই রাজ্যপালের প্রতিক্রিয়ার ভাষা ও ভঙ্গি হুবহু এক নয়, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই প্রশাসনের সমালোচনাটি স্পষ্ট। তখনকার রাজ্যপাল তাঁহার এক্তিয়ার লঙ্ঘন করিতেছেন কিনা, সেই তর্কও উঠিয়াছিল। বর্তমান রাজ্যপালের প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া উচিত হইয়াছে কি না, সে প্রশ্নও হয়তো উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কিন্তু তাহাতে ভাঙড়ের বামনঘাট এলাকার অপকাণ্ড ও তাহার আনুষঙ্গিক আস্ফালন ও জঙ্গিপনার গুরুত্ব হ্রাস পায় না। বস্তুত, রাজ্যপালের বক্তব্যেও দুষ্কৃতী দমনে পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার এবং দোষীদের শনাক্ত করিতে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ হওয়ার যে পরামর্শ আছে, তাহা নির্বাচিত সরকারের রাজধর্ম পালনের নৈতিক দায়কেই তুলিয়া ধরে।
রাজধর্মের মূল কথাই হইল, দলমতনির্বিশেষে নাগরিকদের সুশাসন দেওয়া এবং তাঁহাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা। প্রতিপক্ষ দলের বর্ষীয়ান নেতাদের শারীরিক নিগ্রহে অপরাধীদের শাস্তিদানের বদলে ঘটনাটিকেই তুচ্ছ করা, শাসক দলের সমর্থকদের যথেচ্ছ তাণ্ডবের সময় পুলিশের প্রয়োজনীয় তৎপরতা না দেখানো, মন্ত্রী হইয়াও ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে’ কার্যত বিরোধী দলের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার ‘হুমকি’ দেওয়া কিংবা মহাকরণে দাঁড়াইয়া দলীয় কর্মসূচির সময়সারণি ঘোষণা করা নিশ্চিত রূপে যাবতীয় রাজধর্মের পরিপন্থী। যদি দেখা যায়, শাসক দলের মন্ত্রীরা ক্রমাগত বাহুবলীদের কাঁধে ভর দিয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করিয়া চলিয়াছেন, গণতন্ত্রে সেটাকে কাম্য বলা যায় না। প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা হইতে বিচ্যুতিই রাজধর্মভ্রষ্ট হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এই বিচ্যুতি কিন্তু পুলিশ, জেলা ও ব্লক স্তরের সরকারি আধিকারিক, পুর ও পঞ্চায়েত স্তরের ভারপ্রাপ্ত অফিসার সকলের তরফেই ঘটিতেছে। ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে’ নাগরিকরা যে অবিচারের শিকার হইতেছেন, তাহাতে সাধারণ্যে ক্ষোভ সঞ্চিত হইতেছে। কেবল সিপিআইএম-বিরোধী বিষবাষ্প উদ্গিরণ করিয়া সেই ক্ষোভ প্রশমিত করা যাইবে না। জনসাধারণ সুশাসন দেখিতে চান, আইনের শাসনও। ‘উদ্যমী ছেলে’ কিংবা ‘তাজা নেতা’র আঙুল-নাচানো ঔদ্ধত্য নয়।
রাজ্যপালের বক্তব্যে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ইঙ্গিত রহিয়াছে। এই দুর্বৃত্তায়ন পরিবর্তিত জমানার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নয়, দীর্ঘ কাল ধরিয়াই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দুষ্কৃতীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই জমানাতেও সেই ধারার পরিবর্তন ঘটে নাই, বরং আজিকার ভৈরবরা বামফ্রন্ট আমলের হার্মাদদেরই বংশধর। ‘পরিবর্তিত’ জমানায় এই দুর্বৃত্তায়ন প্রথম স্পষ্ট হয় কলেজে-কলেজে ছাত্র-সংসদের নির্বাচন উপলক্ষে। গোটা রাজ্যেই অধ্যক্ষ ঘেরাও, শিক্ষক নিগ্রহ, প্রতিপক্ষ দলের পড়ুয়াদের মারধর ইত্যাদি দস্তুর হইয়া ওঠে। পুলিশ প্রশাসনেরও নিরপেক্ষ ভূমিকার বদলে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নজরে পড়ে। বিশেষত পুলিশের ভূমিকা, শাসক দলের স্নেহপুষ্ট দুষ্কৃতীদের ‘ছোট ছোট ছেলে’ বলিয়া উদার প্রশ্রয় দানের তৎপরতা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে সঙ্কুচিত করিয়াছে। শিক্ষা ছাড়াও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, হাসপাতাল পরিচালনায়, নানা স্থানে নিয়োগ-বদলিতে যে অগণিত স্বজনপোষণের অভিযোগ, নানা অঞ্চলে যে নির্বিচার তোলাবাজি, ধর্ষিতার ‘চরিত্রদোষ’ লইয়া ক্ষমতাবানদের যে কটাক্ষ, ‘সাজানো ঘটনা’র নিদান দিয়া ও নিরপেক্ষ পুলিশ অফিসারকে বদলি করিয়া পুলিশের উপর যে চাপসৃষ্টি তাহাতে আশঙ্কা হয়, দুর্বৃৃত্তদের উপর নির্ভর করিয়াই কি তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যশাসনে আগ্রহী? পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা কি এক দুর্বৃত্তরাজ হইতে আর এক দুর্বৃত্তরাজের লোফালুফি খেলিবার জন্যই নিয়তিনির্দিষ্ট? |