আর কিছু করতে হবে না, তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে। এটাই স্বামী বিবেকানন্দের
চিন্তার
সারাৎসার।
আমরা তাঁকে যে ভাবে দেখেছি, সেটা অন্ধের খণ্ডদর্শন। মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদ
তপন রায়চৌধুরী।
আগামী কাল স্বামীজির জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হবে। |
বিবেকানন্দ সম্বন্ধে লিখতে গেলে প্রথমেই একটা কথা বলা জরুরি। গরিব মানুষের অবস্থা, তাদের সম্ভাবনা, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাটা ভারতীয় ঐতিহ্যে তেমন ছিল না। সেখানে কর্মফল, নিয়তি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর সাকার না নিরাকার তা নিয়ে তর্ক হয়েছে। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা-র মতো দার্শনিক চিন্তা এসেছে। কিন্তু খিদেয় কাতর, অপুষ্টি, অশিক্ষা এবং কুসংস্কারে জড়ভরত বিশাল জনপিণ্ডের কথা সেই ঐতিহ্যে বিশেষ ভাবা হয়নি।
ইউরোপে অবশ্য ওই ঐতিহ্য ছিল। দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের উত্থান ঘটানো। মিশনারি কার্যকলাপ সেখানে গির্জাতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বিবেকানন্দের উদ্যোগে যে ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’ তৈরি হল, সেখানে আর্ত মানুষের সেবা, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান ইত্যাদি সূচি তৈরি হল পাশ্চাত্যের দেখানো আলোর শিখা মেনেই।
পাশ্চাত্যের দেখানো আলো, কিন্তু পথটি নিজস্ব। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, ভূদেব থেকে রবীন্দ্রনাথ অবধি উনিশ শতকের পুরোধাদের বৈশিষ্ট্য সেটিই। উনিশ শতকের নবজাগরণকে অনেকে আজকাল ইউরোপীয় ভাবাদর্শের আধিপত্য বা ‘হেজিমনি’র প্রভাব ভাবেন। আমি মানতে নারাজ। দুধের সঙ্গে লেবুর জল মেশালে দুধ, লেবু কোনও কিছুর আলাদা অস্তিত্ব থাকে না, উল্টে ছানা নামে নতুন এক সুস্বাদু বস্তু তৈরি হয়। উনিশ শতকের নবজাগরণও সেই রকম। সেখানে ভারত এবং ইউরোপের অনেক ঐতিহ্য মিলেমিশে সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তাধারা। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই তূরীয়ানন্দকে সেই নতুন চিন্তা থেকেই লেখেন, ‘তোমার পূর্বপুরুষ না-হয় দুটো বেদ, উপনিষদ লিখেছে, দুটো মন্দির তৈরি করেছে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? জাতপাতে দীর্ণ, অসহায়, দরিদ্র মানুষরাই সভ্যতার স্রষ্টা।’ |
সেই গরিব মানুষদের খেতে দিতে হবে। অপুষ্টি, রোগ থেকে তাদের শরীরটা বাঁচাতে হবে। কুসংস্কার থেকে বের করে এনে তাদের মনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। জাগাতে হবে তাদের আত্মবিশ্বাস। বিবেকানন্দ বলেন, তার পর তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে। এটিই তাঁর সামগ্রিক চিন্তাধারার সারাৎসার।
এই চিন্তাধারা নিয়েই আমরা অন্ধের হস্তিদর্শন সম্পূর্ণ করলাম। কেউ দেখল হাতির লেজ, কেউ বা শুঁড়, কেউ বা তার বিশাল দেহ। কেউ তাঁকে মনে করলেন, স্বাদেশিকতার পথিকৃৎ। কারও বা মনে হল, তিনি হিন্দু পুনরুত্থানের অগ্রদূত। কেউ ভাবলেন, তিনি শুধুই শিবজ্ঞানে জীবসেবা করতে বলেছেন। দেড়শো বছর ধরে বিবেকানন্দকে নিয়ে আমরা এ ভাবেই খণ্ডদর্শনে মেতে আছি।
খণ্ডদর্শনের একটা উদাহরণ দিই। বৌদ্ধ মঠ ও খ্রিস্টান মিশনের আইডিয়া মিলে তৈরি হল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। কিন্তু সেবা, শিক্ষা ইত্যাদির পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারিদের অন্যতম কাজ ধর্মান্তরকরণ। অন্য লোককে খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা। বিবেকানন্দ কিন্তু এই ধর্মান্তরকরণ মানেন না। মায় অন্য ধর্মের লোককে হিন্দু করতেও চান না। ১৮৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসভায় ‘হিন্দুধর্ম’ শীর্ষক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ তাই বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ধর্মেই ঈশ্বর আছেন।... যিনি হিন্দুর ব্রহ্ম, পারসিকদের অহুর মজদা, বৌদ্ধদের বুদ্ধ, ইহুদিদের জিহোভা, খ্রিস্টানদের ‘স্বর্গস্থ পিতা’, তিনি এই মহৎ ভাব কার্যে পরিণত করার শক্তি দান করুন।’ বিবেকানন্দ মুঘল ভারতের স্থাপত্য, চিত্রকলার ভক্ত। ভারতভ্রমণে বারাণসী, হরিদ্বারের পাশাপাশি আগ্রার তাজমহল দেখেও মুগ্ধ হয়েছেন। বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে তাই একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। হিন্দুত্ববাদীরা যেন তাঁকে নিজেদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার না করতে পারে। নরেন্দ্র মোদী গুজরাত ভোটের আগে বললেন, ‘বিবেকানন্দ শুধু শক্তসমর্থ, উজ্জ্বল এক ভারত চাননি, তরুণরা সেই ভারতের রূপকার হোন তাও চেয়েছিলেন।’ বিবেকানন্দ শক্তিমান ভারত চেয়েছিলেন অবশ্যই, কিন্তু সেই শক্তি হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়, ‘ঐসলামিক পেশি এবং হিন্দু মস্তিষ্ক’। গোধরা গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত নেতা এই সমন্বয়ে বিশ্বাস রাখেন তো?
বিবেকানন্দের ধর্ম-সমন্বয় চিন্তাটা অন্য রকম। সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, ‘হিন্দুর ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম’, লিখছেন তিনি। অন্য দিকে রামমোহন, কেশবচন্দ্র সেন সাম্প্রদায়িক নন, কিন্তু তাঁরা সব ধর্ম মিলিয়ে একটি উদার চিন্তার সেতু বাঁধতে চান। বিবেকানন্দ এই রকম গোদা সেতু বাঁধতে চান না। তাঁর গুরু রামকৃষ্ণের ‘যত মত, তত পথ’ বাণীর প্রেরণায় তিনি মনে করেন, সব ধর্মের মধ্যে মূলগত একটি ঐক্য আছে। সেটিকে স্বীকার করতে হবে।
রামকৃষ্ণ নিজের জীবনে বহু সাধনার পথ পেরিয়ে ওই উপলব্ধিতে পৌঁছন। বিবেকানন্দ সেই উপলব্ধিকে দেখেন বেদান্তের আলোয়। উপনিষদই তো বলে, ‘একম্ সদ্, বিপ্রো বহুধা বদন্তি।’ মানে, সত্য একটিই, ঋষিরা তাকে নানা ভাবে বলেন। ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদের মতো ধর্মচেতনাতেও ধাপে ধাপে অভিব্যক্তির কথা বলেন তিনি। শুরুতে দ্বৈতবাদ। জীব আর ঈশ্বর আলাদা। আরও অগ্রসর হলে, অদ্বৈতবাদ। তখন জীব আর ঈশ্বরে ফারাক নেই। শিকাগো ধর্মমহাসভায় ‘হে আমার আমেরিকাবাসী ভাইবোনেরা’ সম্বোধন সবাই জানে। কিন্তু খেয়াল রাখে না, ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সেই বক্তৃতাতেই তিনি একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন, যার অর্থ: ‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুয়াং...’ মানে, বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু সকলে এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়। সে রকম রুচির বৈচিত্র্যবশে যারা নানা পথে চলছে, ঈশ্বরই তাদের লক্ষ্য। পুরো বক্তৃতাটা নরেন্দ্র মোদীর বোধ হয় ভাল ভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি। নইলে ভোটের আগে, ‘দুনিয়ায় ৯/১১ দুটি বিপ্লব এনেছিল। এক ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার্স ধ্বংস হয়েছিল, আর এক ১১ সেপ্টেম্বর বিবেকানন্দ শিকাগোয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন’ বলতেন না। বিমান ছিনতাই, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ধর্মীয় সংঘাত আর বিভেদের রাজনীতির সঙ্গে বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার তুলনা?
হিন্দুত্ববাদীরা এ রকমই। নিজেদের ভোট বাড়াতে বিবেকানন্দর চিন্তা বিকৃত করে তাঁকে তুরুপের তাস বানাতে চায়। সার্ধশতবর্ষে এদের থেকে সতর্ক থাকা পবিত্র কর্তব্য!
|