নিজস্ব সংবাদদাতা • অন্ডাল |
ভাঙড় নিয়ে রাজ্য রাজনীতি যখন উত্তাল, পাল্টা রাজনৈতিক গুন্ডামির অভিযোগ উঠল সিপিএমের বিরুদ্ধে।
ভাঙড়ে অভিযোগের তির ছিল মূলত তৃণমূলের দিকে। বৃহস্পতিবার বর্ধমানের অন্ডালে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার জন্য জড়ো হওয়া তৃণমূলের লোকজনকে নিশানা করে গুলি ছোড়া হয়। তৃণমূলের দাবি, ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ‘সিপিএম-আশ্রিত’ কয়লা-মাফিয়া তথা সিটু নেতা বিজয় সিংহ। আহত অন্তত তিন জন। পুলিশ জানায়, বিজয় সিংহ পলাতক। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর পুত্রবধূকে আটক করা হয়েছে। মোট ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। রাত পর্যন্ত গ্রেফতার চার জন। |
ভাঙড়ের ক্ষেত্রে তৃণমূল যেমন আগাগোড়া আরাবুল ইসলামকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছে, পরাশকোল কোলিয়ারির সিটু অনুমোদিত সংগঠনের সম্পাদক বিজয় সিংহের পাশে তেমনই দাঁড়িয়েছেন সিপিএম নেতারা। দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “বিজয়দের ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। জনসভায় যাওয়ার আগে তৃণমূলের লোকজনই আমাদের পার্টি অফিস ভাঙচুরের চেষ্টা করে। স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেন।” পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক তথা দামোদর-অজয় জোনাল সম্পাদক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “তৃণমূলের লোকজনই গুলি চালিয়েছে।” আসানসোলের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটকের পাল্টা বক্তব্য, “গত দশ বছরে এই বিজয় সিংহদের ময়দানে নামিয়ে এলাকায় বিরোধী-শূন্য ভোট করাত সিপিএম। পঞ্চায়েত ভোটের আগেও ওরা একই জিনিস করতে চাইছে।” |
আসানসোলের সভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কয়লা মাফিয়াদের দিয়ে অশান্তি পাকানোর চেষ্টা চলছে। পুলিশ কমিশনারেটকে নির্দেশ দিচ্ছি, সমস্ত বেআইনি অস্ত্র যেন উদ্ধার করা হয়। অন্ডাল থেকে কোনও বেআইনি অস্ত্র যেন ঢুকতে না পারে।” দীর্ঘ দিন অন্ডাল এবং লাগোয়া পাণ্ডবেশ্বরে বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে বেআইনি অস্ত্র ঢোকে। অস্ত্রের অন্যতম প্রধান উৎস ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া জেলার নলা এলাকা। গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, মূলত দু’টি রাস্তায়
১) বারাবনি ও জামুড়িয়া হয়ে অথবা
২) দুমকার পলাশথলি থেকে বীরভূমের ভীমগড়া হয়ে অস্ত্র ঢোকে অন্ডাল-পাণ্ডবেশ্বরে।
এ দিন সন্ধ্যায় আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ বলেন, “অন্ডালের মুকুন্দপুর, খাসকাজোড়া, মধুসূদনপুর ও পরাশকোলে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে বলে খবর রয়েছে। সেখানে লাগাতার অভিযান হবে।” ঘটনার সূত্রপাত এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ। আসানসোলে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার জন্য অন্ডালের পরাশকোলে বাসে উঠছিলেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। |
পাণ্ডবেশ্বর ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি বীরবাহাদুর সিংহের অভিযোগ, তখন বিজয় সিংহের দলবল সেখানে হাজির হয়ে সভা থেকে ফেরার সময়ে তৃণমূল কর্মীদের মারধর করার হুমকি দেয়। কয়েকজন তৃণমূল কর্মী প্রতিবাদ করলে তারা গুলি চালায়। বোমাও ফাটানো হয়। তবে বাস থেকে তৃণমূলের লোকজন নেমে আসতেই ওই দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। সিপিএমের পাল্টা দাবি, সভায় যাওয়ার পথে তিনটি বাসে করে তৃণমূলের লোকজন এসে তাদের পার্টি অফিসে চড়াও হয়। পুলিশের সামনেই রড-লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে তারা। এর পরে বিজয় সিংহ-সহ কয়েক জনের বাড়িতে হামলা চালানো হয়।
|
অন্ডালে তৃণমূল কর্মীদের উপরে হামলায় প্রধান অভিযুক্ত সিটু নেতা বিজয় সিংহ। কে এই বিজয়? তাঁর পারিবারিক পরিচয়ই বা কী?
পুলিশ বলছে: বিজয় সিংহের ভাল নাম অরুণ সিংহ। অন্ডালের পরাশকোল কোলিয়ারির কর্মী এবং সেখানকারই সিটু সংগঠনের সম্পাদক। অভিযোগ ছিল, আটের দশকের প্রথম দিকে অবৈধ কয়লা কারবারে বাধা দেওয়ায় খাসকাজোড়া কোলিয়ারির নিরাপত্তারক্ষী হরিনারায়ণ নুনিয়ার গলা কেটে তার কাটা মুন্ডু ট্রে-তে মধ্যে সাজিয়ে এলাকায় ঘুরেছিলেন তিনি। গ্রেফতার হলেও পরে জামিন হয়ে যায়। সাক্ষ্যের অভাবে পরে বেকসুর খালাসও হয়ে যান। |
গোয়েন্দা সূত্রের খবর: ওই ঘটনার পরেই বিজয় এলাকার সবচেয়ে বড় কয়লা মাফিয়া হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। এক সিটু নেতার ছত্রতচ্ছায়ায় ‘সিপিএমের লোক’ও হয়ে ওঠেন। পরাশকোল কোলিয়ারি থেকে বেরনো মালগাড়ির দু’-একটি বগি খালি করা ছিল তাঁর নিত্য দিনের কাজ। শেষ দিকে সিপিএমের এক অন্যতম প্রভাবশালী জেলা নেতার ঘনিষ্ঠও হয়ে ওঠেন। পরিবার: বিজয়ের দাদা গুপ্তেশ্বর সিংহ এক সময়ে বহুলা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন। প্রথমে নির্দল হয়ে ভোটে জিতে তিনি সিপিএমে যোগ দেন। বছর পাঁচেক আগে তাঁর ছেলে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে ছত্তীসগঢ়ের এক ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করে খুন করার অভিযোগ ওঠে। পুলিশ সূত্রের খবর, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলেকে ফোনে খাসকাজোড়ায় ডেকে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছিল। তার পরেও ইঞ্জিনিয়ারকে গুলি করে মারা হয়। পুলিশ কৃষ্ণকে গ্রেফতার করেছিল। কিছু দিন জেল খেটে বেরিয়ে সে আপাতত পলাতক। |
তথ্য: নীলোত্পল রায়চৌধুরী। |