ভাবলে আজ বেশ অবাকই লাগছে।
পাকিস্তান থেকে ফ্লাইট ধরছি। সঙ্গে দেশজ মিডিয়ার জনা কয়েক বন্ধুবান্ধব। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছিলাম, পাঁচ বছর পর ভারত সফরে যাচ্ছি, জানি না লোকে কেমন ব্যবহার করবে। সব মিলিয়ে একটু টেনশনেই ছিলাম। একজন তো বলেও ফেলল, বাড়িতে বউ-বাচ্চা রেখে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। পনেরো দিন বাইরে থাকব, কী ভাবে যে কাটবে!
রবিবার রাত্তিরে এই লেখাটা যখন লিখতে বসছি, ততক্ষণে এ বারের ভারত সফর থেকে শেষ কপিটা অফিসে পাঠানো হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছি মনটা খারাপ, খুব খারাপ।
সত্যি বলতে, আপনাদের দেশ ছেড়ে যেতে আজ ইচ্ছে করছে না!
বিশ্বাস করুন, ভারতে আসার সময় ভাবতে পারিনি এত সুন্দর সুন্দর সব মুহূর্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ক্রিকেটীয় দিক থেকে তো বটেই, ক্রিকেটের বাইরের কথাটাও বলতে হবে। ২০০৪ সালে আমরা পিছিয়ে পড়ে সিরিজ ২-১ জিতেছিলাম। এ বার টি-টোয়েন্টি সিরিজ ড্র করেছি। ওয়ান ডে সিরিজ জিতলাম ২-১। দিল্লি ম্যাচটা আমরা হেরে গেলাম নিজেদের দোষে। মিসবাই শেষ করে দিল। ওকে আমাদের দেশে বলা হয় ‘টুকটুক’। ঢিকিরঢিকির করে বলে। কোটলাতেও করল। ভাগ্যিস সিরিজটা আগে জিতেছিল, নইলে কোটলার পর ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ত।
এ বারের সিরিজ জয় ২০০৪-এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ বার আমরা এমন কিছু তরুণ ক্রিকেটারকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি, যাদের ক্রিকেটবিশ্ব সে ভাবে আগে চিনতই না। যেমন জুনায়েদ খান। ভারত সফরের আগে কেউ জানত, ও এমন সুইং করাতে পারে? ইরফানকেও পাওয়া গেল। এই দু’জনকে তো সিরিজের আবিষ্কার বলা যেতে পারে। |
জুনায়েদ খান: ৩ ম্যাচে ৮ উইকেট |
আর আপনাদের দেশের অভ্যর্থনা নিয়ে কী বলব? যা বলব, সেটাই কম পড়বে। শুধু যখন ভিসাটা বার করতে হচ্ছিল, তখনই শুধু মনে পড়ে যাচ্ছিল আমি পাকিস্তানি। বাকি সময় মনে হয়েছে আমি তো আপনাদেরই মতো। একজন ভারতীয়! আমি ভাবতে পারিনি কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর সময় একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে বলবেন, “আপনি মজিদ ভাট্টি না? পাকিস্তান থেকে এসেছেন? আজ আপনার ছবি বেড়িয়েছে। আসুন, মিটারের চেয়ে কম দেবেন!” জানেন, অফিস থেকে যে অ্যালাওয়েন্স আমি পেয়েছিলাম, তার প্রায় পুরোটাই বেঁচে গিয়েছে? একদিনও আমাকে লাঞ্চ বা ডিনারের বিল মেটাতে হয়নি! আজ এ খাওয়াচ্ছে, কাল ও।
ভারতের পাঁচ-পাঁচটা জায়গায় ঘুরলাম ম্যাচ কভার করতে। কত অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা হল। আমদাবাদ থেকে চেন্নাই যাচ্ছি। ফ্লাইটে এক পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল। কথা বলে জানতে পারলাম, ওঁদের আদি বাড়ি নাকি করাচিতে। ওঁদের পূর্বপুরুষ সেই ’৪৭-এর দেশভাগের সময় জন্মভিটে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। আমি পাকিস্তানের শুনে ওঁরা আমার ফোন নম্বর নিলেন। বললেন, পাকিস্তানে ফিরে করাচিতে ওঁদের জন্মভিটেতে একবার যেতে। জানাতে, বাড়িটা আজও আছে কি না! আশ্চর্য, না?
আশ্চর্যের আরও বাকি ছিল। দিল্লিতে কেনাকাটা করতে একদফা অপ্রস্তুত হলাম। স্ত্রী-মেয়ের জন্য জুতো কিনতে ঢুকেছিলাম। দোকানদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরোল, সে নাকি আমারই মতো ফয়জলাবাদের। ব্যস, শুনেই ডিসকাউন্টের হিড়িক!
কলকাতাকেও বা ভুলি কী করে? সত্যি বলতে, আপনাদের শহরকেই সবচেয়ে ভাল লেগেছে। ইডেন গার্ডেন্স নিয়ে যত বলব, ততই কম পড়বে। ইডেনই বোধহয় ভারতের একমাত্র মাঠ যেখানে দু’টো টিমই সমান সমর্থন পায়। তা ছাড়া এ বারই প্রথম আমি বাঙালি খাবার খেলাম। এক কথায় দুর্ধর্ষ লেগেছে আপনাদের রেসিপি। আর একদিন চায়না টাউন গিয়েছিলাম। ওটাও অসাধারণ। আসলে ভারতের খাবার আমার বরাবরই পছন্দের। দিল্লিতে একটা ককটেল পার্টিতে গিয়ে শুধু অপেক্ষা করেছি কখন ডিনার সার্ভ করবে। আমি মদটদ খাই না। কিন্তু ভাল খাবারের অসম্ভব ভক্ত। এই তো দেখুন না, দেশে ফেরার আগে কাজু বরফি নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির অর্ডার!
তবু বলব, এই সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলোও পিছনে আসবে। যদি জিজ্ঞেস করেন, ভারত সফর থেকে আমি সেরা কোন জিনিসটা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি, এক শব্দে উত্তর দেব।
আমন।
দেখুন, আমাদের দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের দিনগুলো খুব কষ্টে কাটে। কেউ তো আসতেই চায় না আমাদের দেশে। ভারত আসে না কত দিন। বাংলাদেশও সফর বাতিল করে দিল। অথচ আপনাদের দেশের মতো পাকিস্তানের মানুষও লাহৌর বা করাচিতে ভারত-পাকিস্তান দেখতে চায়। একজন পাকিস্তানি হিসেবে আমি অসম্ভব কৃতজ্ঞ ভারতীয় বোর্ডের কাছে। এন শ্রীনিবাসনের কাছে। উনি তো সম্পর্কটাকে আবার চালু করেছেন। চলতি সফরে কোনও সেন্টারেই পাকিস্তান নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। একটা শান্তির পরিবেশ ছিল। বন্ধুত্বের আমেজ পেয়েছি। অর্থাৎ, দু’দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্কে শান্তি ফেরার ইঙ্গিত। মানে, আমন আসছে। মেনে নিচ্ছি, পাকিস্তানকে পুরোপুরি সুরক্ষিত আজও বলা যায় না। কিন্তু আমরা তো আশ্বাস দিচ্ছি আপনাদের। ভারতীয় বোর্ডকে অনুরোধ করছি, আমাদের আশ্বাসকে বিশ্বাস করুন। ধোনিদের পাঠান পাকিস্তানে। তাতে দু’দেশের ক্রিকেটেরই মঙ্গল। উমর আকমল, জুয়ানেদ খানরা তো এখনও জানলই না দেশের মাটিতে ইন্ডিয়া ম্যাচ খেলতে কেমন লাগে।
ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছেও একটা অনুরোধ আছে। টিম এলে, আপনারাও কিন্তু পাকিস্তানে আসবেন। এ বার আপনারা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। একবার আসুন, দেখবেন আমাদের ‘মেহমান নওয়াজি’ কাকে বলে! |