|
|
|
|
স্থানীয়দের তৎপরতায় বাঁচল ছ’টি প্রাণ |
কিংশুক গুপ্ত • মানিকপাড়া |
স্কুলে পড়ার সময় বয়েজ স্কাউটের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল প্রসাদ মাহাতো, সঞ্জয় মাহাতো ও ললিত মাহাতোদের। রবিবার ভোররাতে বিপদ দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই তিন যুবক। কিন্তু মানিকপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী কৃষ্ণেন্দু সেন, অমলেশ সাউ ও দিলীপ ভূঞ্যাঁদের মতো আমজনতার বিপর্যয় মোকাবিলা করার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁরা সকলেই হাতে -হাত ধরে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের গ্রাস থেকে বাঁচালেন ৬টি প্রাণ।
ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ায় অবসরপ্রাপ্ত ডাক -কর্মী অধীনচন্দ্র দত্তের অভিশপ্ত দোতলা বাড়িটির এক তলার যে ঘরে তাঁর ছোট ছেলে সঞ্জীব দত্ত ওরফে টুলুর ইলেকট্রনিক্স -সরঞ্জাম মেরামতির দোকান ছিল, সেই ঘর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা ও কালো ধোঁয়া কার্যত গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। রবিবার ভোর রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ কৃষ্ণেন্দুবাবুরা পৌঁছে যান সেখানে। বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকেন তাঁরা। আসে পুলিশও। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “আগুনের তাপে বাড়িটার ধারে পাশে যাওয়া যাচ্ছিল না। টুলুর (সঞ্জীব দত্ত) মোবাইল ফোন বেজে যাচ্ছিল। বাড়িটির সব ক’টি জানালা লোহার ফ্রেম লাগানো কাঁচের। পাগলের মতো জানালার কাঁচগুলো ভাঙছিলাম আমরা।” এর মধ্যে বাড়ির এক তলার পিছনের দরজা খুলে কোনও মতে বেরিয়ে আসেন অধীনবাবুর স্ত্রী কল্যাণীদেবী, তাঁর বিবাহিতা মেয়ে স্বপ্না বেরা, স্বপ্নাদেবীর এগারো বছরের মেয়ে পুষ্পিতা ও ছয় বছরের ছেলে সাগর। |
আগুন নেভার পরে বাড়ির ভিতরে দমকলকর্মীরা। |
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনিতা মাহাতো।
|
উদ্ধারের পরে অধীনবাবুর স্ত্রী -মেয়ে -নাতি -নাতনিরা।
|
হাসপাতালে নীলাদ্রি।
|
ছবিগুলি তুলেছেন দেবরাজ ঘোষ। |
|
দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে মানিকপাড়ায় বাপের বাড়িতে থাকেন স্বপ্নাদেবী। পুষ্পিতা ও সাগর মানিকপাড়ার স্কুলে পড়ে। রবিবার প্রতিবেশী তরুণ মহাপাত্রের বাড়িতে বসে স্বপ্নাদেবী বলেন, “ভাইয়ের দোকান ঘর থেকে প্রচণ্ড শব্দে টিভি ও ফ্রিজের যন্ত্রাংশ ফাটার আওয়াজে ঘুম ভাঙে। আমরা এক তলার পিছনের ঘরে শুয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি মা ও ছেলে -মেয়েকে নিয়ে পিছনের দরজা খুলে বেরোই। কিন্তু আগুনের গ্রাস থেকে কোন দিকে যাব বুঝতে পারছিলাম না। স্থানীয় যুবকেরা আমাদের বার করে নিয়ে আসেন। ঘটনাটা ভাবলেই শিউরে উঠছি।” পুষ্পিতা ও ছোট্ট সাগরের চোখেমুখে আতঙ্ক। স্বামী, দুই ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন কল্যাণীদেবী।
সঞ্জীববাবুদের বাড়ির পাশেই টিঙ্কু রাম ও দেবু রামের বাড়ি। দুই সহোদর তরুণ জানালেন, তাঁদের বাড়ির এক তলার ছাদ থেকে সঞ্জীববাবুদের দোতলার পশ্চিম দিকের জানালার কার্নিসে বাঁশের মই লাগানো হয়। ওই ঘরটিতে ভাড়া থাকতেন কালীপদবাবু। মই বেয়ে হাতুড়ি -শাবল দিয়ে জানালা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন পাপাই দাস, দেবু রাম, টিঙ্কু রাম ও সঞ্জয় মাহাতোর মতো এলাকার বেশ কিছু তরুণ। সঞ্জয় ও প্রসাদ মাহাতোরা বলেন, “ধোঁয়ার চোটে কালীপদ মাহাতোর স্ত্রী অনিতাদেবী ও তাঁর আট বছরের ছেলে নীলাদ্রি চিৎকার করতে -করতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। মই বেয়ে ওদের বার করাটাই আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। তখন বিপদের কথা মনে আসেনি।”
রবিবার ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনিতাদেবী অস্ফূটে বলেন, “ওই ছেলেগুলো দেবদূতের মতো আমাকে ও নীলাদ্রিকে টেনে বার করেছিল।” কালীপদবাবুর মৃত্যুর খবর অবশ্য অনিতাদেবীকে জানানো হয়নি।
পাপাই, দেবুদের আক্ষেপ, “কালীপদবাবু যদি এক তলার দিকে না নামতেন, তাহলে হয়তো তাঁকেও বাঁচানো যেত।” সঞ্জীববাবুকে দোতলার জানালা ধারে চিৎকার করতে দেখেছিলেন টিঙ্কুরা। তাঁদের কথায়, সময় মতো আগুন নেভানো গেলে অধীনবাবুদের সবাইকেই হয়তো বাঁচানো যেত। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঝাড়গ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মানিকপাড়ার ওই ঘটনাস্থলে দমকল পৌঁছয় প্রায় দু’ঘন্টা দেরিতে। ঝাড়গ্রাম দমকল কেন্দ্রের এক আধিকারিক অবশ্য বলেন, “খবর পাওয়ার পরই আমরা রওনা দিই। ২৫ কিমি পথ যেতে কিছুটা সময় তো লাগবেই।” দমকলকর্মীরা আগুন নেভানোর পর ৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করেন দমকলকর্মী ও এলাকাবাসী। |
|
উদ্ধারকারী স্থানীয় বাসিন্দারা। —নিজস্ব চিত্র। |
পীযূষের স্ত্রী অনুপমার বাপের বাড়ি বালিচকের গোপীনাথপুরে। আগামী ২১ জানুয়ারি পীযূষ -অনুপমার আট মাসের ছেলে শৌভিকের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান ছিল। জামাই, মেয়ে ও নাতিকে হারিয়ে হাউ -হাউ করে কাঁদছিলেন অনুপমার বাবা দুর্গাপদ হড়। খবর পেয়েই গোপীনাথপুর থেকে মানিকপাড়ায় ছুটে আসেন তিনি। কিন্তু তার আগেই নিথর দেহগুলি ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের পুলিশ মর্গে চলে গিয়েছে। ললিত মাহাতো, কৃষ্ণেন্দু সেনদের বক্তব্য, মানিকপাড়ার মতো জনবহুল এলাকায় দমকলের একটি ইঞ্জিন রাখার ব্যবস্থা করা হোক। মানিকপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতেও কোনও পরিকাঠামো নেই বলে তাঁদের অভিযোগ।
সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যেই ঝাড়গ্রামের এসপি ভারতী ঘোষ, জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত, ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক বাসব বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন। পরে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা, তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়, জেলা কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষেরা আসেন। ঘুরে যান সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডহরেশ্বর সেনও। মন্ত্রী সুকুমারবাবু বলেন, “ঘটনাটি মর্মান্তিক। এলাকার যাঁরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সাহসের সঙ্গে উদ্ধার -কাজ করেছেন, তাঁদের সম্মানিত করার কথা ভাবা হচ্ছে।” |
|
|
|
|
|