নয়াদিল্লির গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদের আড়ালে-আবডালে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই আসরে অবতীর্ণ। তন্মধ্যে বিজেপির নেতা মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী কৈলাস বিজয়ভার্গীয় মহোদয়ের প্রতিক্রিয়া প্রথম স্থান অর্জন করিতে পারে। তিনি মর্যাদার ‘লক্ষ্মণরেখা’ অতিক্রম করার দায় মহিলাদের উপর ন্যস্ত করিয়াছেন এবং পরিণামস্বরূপ ওত পাতিয়া থাকা রাবণদের হাতে সীতাহরণের অনিবার্যতার কথা বলিয়াছেন। নারী নিজে যদি আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করে কিংবা ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন পোশাক না পরিয়া পাশ্চাত্যের অনুকরণে লিপ্ত হয়, তবে এমনই ঘটিবে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো আশ্চর্যের কিছু নাই। নারীর মর্যাদাকে তাহার চরিত্রের সতীত্ব (অর্থাৎ যোনির অক্ষত দশা), পোশাকের শুচিতা ইত্যাদির সহিত একাত্ম করিয়া তাহা রক্ষার দায় সমাজের পরিবর্তে ‘বিপথগামী’ নারীর উপরেই ন্যস্ত করিয়া নিশ্চিন্ত হওয়ার সামাজিক বর্বরতায় সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকারের শক্তিই যে সমস্বর হইবে, ইহাই তো স্বাভাবিক। লক্ষণীয়, হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শা গিলানিও মহিলাদের উপর আক্রমণের জন্য তাঁহাদের ‘আধুনিক’ পোশাককে কিয়দংশে দায়ী করিয়াছেন। অন্ধ গোঁড়ামি এবং প্রাচীনপন্থী মন বাস্তবিকই ধর্ম-নিরপেক্ষ।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত আবার দেশকে অবলীলায় সনাতন ও গ্রামীণ ভারত এবং আধুনিক ও নাগরিক ‘ইন্ডিয়া’য় দ্বিধাবিভক্ত করিয়া দেখাইতে চাহিয়াছেন, ধর্ষণ ভারতে কম, ইন্ডিয়ায় বেশি, যেহেতু ইন্ডিয়া পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সরসংঘচালকের এই ঝাঁকিদর্শন তথ্যের বিচারে মিথ্যা। গ্রামীণ ভারতে ধর্ষণের হার নাগরিক ইন্ডিয়া অপেক্ষা অনেক বেশি, ধর্ষণকারীদের সাজাপ্রাপ্তির বিচারে দ্বিগুণেরও বেশি। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেও বলা যায়, ধর্ষণের পিছনে নারীর আত্মমর্যাদার লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘনের ঘটনা নাই। আরএসএসের সনাতন ভারত এই অভিযানের পরিকীর্ণ ভূগোলের বাহিরে নয়, বরং পিতৃতন্ত্রের উৎকর্ষের সনাতনত্বের মধ্যেই নিহিত। ভারতের গ্রামাঞ্চলে আজও যে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-সম্পর্ক বিদ্যমান, তাহা এই সনাতনত্বের সূতিকাগার।
তুলনায় আধুনিক, পাশ্চাত্য শিক্ষায় আকৃষ্ট, পশ্চিমী ধ্যানধারণা ও রীতিনীতির প্রতি অনুরক্ত নাগরিক ইন্ডিয়া বরং পিতৃতন্ত্রের লিঙ্গ-রাজনীতি ও তাহার আনুষঙ্গিক বৈষম্য, প্রতারণা ও জালিয়াতি সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। তাই হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশে, কিংবা রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের গ্রামে দলিত বালিকাকে গণধর্ষণ করিয়া যত সহজে জলে ভাসাইয়া দেওয়া যায়, নয়াদিল্লিতে তত সহজে যায় না। সনাতন ভারতের অনুরাগীরা সনাতন মূল্যবোধ জাগরুক করিতে বলিয়া সমাজকে কার্যত মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের দিকেই টানিতেছেন, যেখানে ধর্ষিতা মহিলারা আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসম্মত প্রতিবিধানের সুযোগ পর্যন্ত পাইতেন না। ভাগবত যাহার চালক, সেই আরএসএস নাকি দেশের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির অভিভাবক, মার্গদর্শক, ইত্যাদি। সনাতন ভারতের ঈশ্বর ভারতের ইন্ডিয়ারও মহিলাদের রক্ষা করুন। |