আলু কিনতে টাকা ধার নিয়েছিল আগের সরকার। পুরোটা তারা মিটিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু নতুন সরকারও সেই দেনা শুধতে নারাজ। যুক্তি, পুরনো সরকার ঋণের টাকা নিয়ে নয়ছয় করেছে। তার বোঝা নতুন সরকার বইবে কেন?
আর এই টানাপোড়েনে কার্যত মাথায় হাত পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের। বকেয়া ১৮০ কোটি টাকার সরকারি ঋণ শেষমেশ অনাদায়ীই থেকে যাবে, এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে ওই অর্থ সংস্থানের জোগাড়যন্ত্র (ব্যাঙ্কিং পরিভাষায়, প্রভিশনিং) শুরু করতে হয়েছে তাদের। সে লক্ষ্যে সরিয়ে রাখতে হচ্ছে মোট মুনাফার বড় অংশ। পরিণাম যা হওয়ার তা-ই। এই খাতে গত অর্থবর্ষে ব্যাঙ্কের লোকসান হয়েছে নয় নয় করে ২২ কোটি!
উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলোয় টানা লাভের মুখ দেখা রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক ২০১১-১২ অর্থবর্ষে লোকসান করেছে মোট প্রায় ৬০ কোটি টাকা। ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: মূলত বিভিন্ন খাতে ‘প্রভিশনিং’ করতে গিয়েই এই ক্ষতির বোঝা তাঁদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। যেমন, বন্ডে লোকসান এবং বিভিন্ন শাখার হিসেব-নিকেশ বাকি থাকার দরুণ প্রায় ৩৮ কোটি টাকার ‘প্রভিশনিং’ করতে হয়েছে। সঙ্গে জুড়েছে রাজ্যের বকেয়া ঋণের আর্থিক সংস্থান বাবদ ওই ২২ কোটি। পাওনা যত দিন না-মিটবে, লোকসানের বহর তত বাড়বে। তাতে সমবায় ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সমূহ। সে ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রে ঋণদানও মার খেতে বাধ্য। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে সব ক’টি ব্যাঙ্ক মিলে যত কৃষি-ঋণ দেয়, তার ৩৫% সমবায় ব্যাঙ্ক একাই জোগায় বলে কর্তাদের দাবি।
২০১০ সালে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চাষিদের থেকে আলু কিনে রাজ্য কম দামে বাজারে বেচবে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের নির্দেশে আলু কেনার
জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক মোট চারশো কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয় কনফেড, বেনফেড ও অত্যাবশ্যক পণ্য নিগমকে। তার ১৮০ কোটি শোধ করা বাকি থাকতে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। বর্তমান তৃণমূল সরকারও তা মেটাতে অস্বীকার করছে। কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় জানাচ্ছেন, আলু কেনার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে সিআইডি তদন্ত করছে। ঘটনায় অন্তত ১৩ জনের বিরুদ্ধে আরামবাগ থানায় এফআইআর করেছে নতুন সরকার। “যে টাকা বামফ্রন্ট সরকার লুঠ করেছে, তা মেটানোর দায় বর্তমান সরকারের নেই।” মন্তব্য অরূপবাবুর।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, গ্যারান্টি দিয়ে রাজ্য সরকার যে ঋণ নিয়েছিল, রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও তা পরিশোধের দায়িত্ব কি নতুন সরকার এড়াতে পারে?
ব্যাঙ্কিং মহলের মতে, পারে না। এক সরকার ঋণ নিলেও পরের সরকার তা শোধ করতে আইনত বাধ্য। তা ছাড়া টাকা ‘লুঠ’ হয়ে থাকলেও তার দায় রাজ্যেরই, কোনও ভাবে সমবায় ব্যাঙ্কের নয়। কারণ, সরকারের নেওয়া ঋণের টাকা কী ভাবে খরচ হয়েছে, তা দেখার দায়িত্ব মূলত সরকারেরই উপরে বর্তায়।
বাম সরকারই বা টাকা পুরো মেটাল না কেন?
বামফ্রন্টের এক প্রতিনিধি তথা প্রাক্তন মন্ত্রী জানান, যখন ২২০ কোটি টাকার মতো শোধ হয়ে গিয়েছিল, তখনই প্রশাসনের নজরে আসে যে, আলু খরিদের প্রক্রিয়ায় মোটা টাকার হিসেব মিলছে না! তাঁর কথায়, “আমরাই আইএএস অফিসার সুব্রত গুপ্তকে দিয়ে এক সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গড়েছিলাম। কমিটির রিপোর্টে নয়ছয়ের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এর মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষিত হয়ে যায়। আমাদের পক্ষে আর কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি।”
ভোটে বামফ্রন্টের ভরাডুবির পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূলের সরকার। নতুন সরকারের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপবাবু বলছেন, “সুব্রতবাবুর রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা বিভাগীয় তদন্ত চালাই। দেখা যায়, প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা লুঠ হয়েছে।” অরূপবাবুর দাবি: সিপিএমের লোকজন টাকাটা লুঠ করেছে, কারণ বামফ্রন্ট সরকার
তাদের দিয়েই আলু কেনার বন্দোবস্ত করেছিল। “এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জনের বিরুদ্ধে আমরা এফআইআর করেছি। অভিযুক্তেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।” বলেন তিনি। যা শুনে প্রাক্তন বাম মন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, “তা হলে পলাতকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে না কেন?”
মন্ত্রী-রাজনীতিকের এ হেন চাপান-উতোরের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের প্রশ্ন। সমবায় ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষের দাবি, মুলতুবি ব্যালান্স
শিট ও বন্ডে লোকসানের দরুণ যে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার ‘প্রভিশনিং’ করতে হয়েছে, তা প্রকৃত অর্থে লোকসান নয়। কেননা তা পরে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট (অর্থাৎ, নোশনাল লস)। যেমন, সুদের হার ওঠা-নামার সঙ্গে বন্ডের দামও কমে-বাড়ে। তাই বন্ড বাবদ ক্ষতি পুষিয়ে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার অসম্পূর্ণ ব্যালান্স শিটের ‘আপাত লোকসান’ চূড়ান্ত হিসেবে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকার ঋণের টাকা ফেরত না-দিলে তা হবে নিট লোকসান।
সেটা ভেবেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ব্যাঙ্কিং-বিশেষজ্ঞেরা। কী রকম?
তৎকালীন হাওড়া গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তথা ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন একজিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত বলেন, “গ্রাহকের গচ্ছিত টাকা থেকেই সমবায় ব্যাঙ্ক রাজ্যকে ঋণ দিয়েছিল। আমানতকারীদের যথাসময়ে টাকা ফেরত দেওয়া ব্যাঙ্কের দায়িত্ব। কাজেই ঋণ আদায় না-হলে পুরো অর্থের সংস্থান সমবায় ব্যাঙ্ককেই করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের নিট সম্পদ (নেট ওয়ার্থ) নেগেটিভ হয়ে পড়তে পারে। তাতে প্রতিষ্ঠানের রুগ্ণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।” উল্লেখ্য, কৃষিক্ষেত্রে দেওয়া ঋণের একটা বড় অংশ নাবার্ডের কাছ থেকে ‘রিফিনান্স’ হিসেবে সমবায় ব্যাঙ্ক পেয়ে থাকে। অনাদায়ী ঋণের বহর বাড়তে থাকলে নাবার্ড-ও সমবায় ব্যাঙ্ককে ঋণদান বন্ধ করে দিতে পারে বলে ব্যাঙ্কিং-বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন।
সব মিলিয়ে সরকারের নেওয়া ঋণ শোধ না-হওয়ার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে ঋণের জোগানে বড় ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এ দিকে টাকা নয়ছয়ের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমস্যার সূত্রপাত, তার পুনরাবৃত্তি রুখতে সুব্রতবাবুর কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। কিন্তু আগের বামফ্রন্ট সরকার কিংবা বর্তমান তৃণমূল সরকার কেউই সেগুলো কার্যকর করতে বিশেষ উদ্যোগী হয়নি বলে প্রশাসনিক সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে। |