|
|
|
|
|
|
|
একটাভয় [কষ্ট] লজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
নলেন গুড়ের মিষ্টি বললেই আমার সেই বৃদ্ধের কথা মনে পড়ে। শীতের দুপুরে একটা হাতওলা গেঞ্জির ওপর মেটে রঙের জোড়া-সাপ ডিজাইনের হাতকাটা সোয়েটার, আর ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পরা। এক কালে সুঠাম ছিলেন বোঝা যায়, এখন চেহারা ভেঙেছে, চওড়া কালো সোয়েটারটা ঝুলছে, পায়ে মোজার সঙ্গে চটি, মোজায় কিছুটা পুঁজরক্ত মতো লাগা, তাই তো মনে হল। জামাকাপড় দেখে বুঝলাম, কাছেপিঠেই থাকেন বোধহয়। দুপুর দুপুর হঠাৎ খেয়াল চেপেছে নলেন গুড়ের মিষ্টির। আমার তখন আঠারো-উনিশ, কোচিং না কোথায় যাচ্ছি, তাঁর সঙ্গে মোলাকাত আমাদের বাড়ির গলির মুখে। আমায় চেঁচিয়ে জিগেস করলেন, ‘এ দিকে ভাল নলেন গুড়ের জলভরা কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারো?’ আচমকা প্রশ্ন, তাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। হাঁ করে ভাবছি, তিনি খুব বিরক্ত হলেন এবং আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ‘ধুস্’ বলে হনহনিয়ে হেঁটে গেলেন।
হঠাৎ মনে হল, আরে, বুড়োর ঠোঁট গড়িয়ে কী যেন পড়ছিল না? থুতু বা লালা নয়, চটচটে মতো। হ্যাঁ, মিষ্টির রস শিয়োর আমি। মনে মনে যা-তা বললাম বুড়োটাকে। কী নোলা রে বাবা! এই বয়েসেও মিষ্টি খাওয়ার লোভ যায় না, কী সব মিষ্টি গিলেছে গাণ্ডেপিণ্ডে, তার পর আবার বেরিয়েছে জলভরার সন্ধানে! বাঙালির এই জন্য কিছু হয় না। যে জাতি দুপুরবেলা কাজ না করে ভাল মিষ্টি খুঁজতে বেরোয়, তার আর যাই হোক তেজ বা সাকসেস কোনওটাই আসবে না।
আবার চটকা ভাঙল সেই বৃদ্ধের ডাকে। ফিরে এসেছেন। এ বার গলাটা খুব আতুর আর করুণ। ‘অ্যাই মেয়ে, আমায় পাঁচটা টাকা দে না, একটু মিষ্টি খাব।’ কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল ভেতরটা। ইনি কি পাগল? তা তো একেবারেই মনে হচ্ছে না। তবে কেন পথে পথে ঘুরে মিষ্টি খেতে চাইছেন? দেখে তো মনে হয় ভাল ঘরেরই মানুষ। ওঁর কাছে টাকা নেই? কী ছিল ওঁর গলার স্বরে! কী ছিল ওঁর চাওয়ার মধ্যে। একটা ভীষণ আকুলিবিকুলি ভাব, একটা গুমরোনো কান্না। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। উনি আহত হয়ে ফের হাঁটা দিলেন। দাঁড়ানোর একটুও সময় নেই যেন। মিষ্টি ওঁকে এক্ষুনি যে করেই হোক খেতে হবে।
আমি ওঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি মিনিট দুয়েক, হঠাৎই দেখলাম উল্টো দিকে কারা যেন রাস্তার লোকের কাছে, দোকানের লোকের কাছে কারও খোঁজ করছেন। দলে রয়েছেন দুজন পুরুষ, বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন, আমাদের বয়সি এক জন ছেলে, আর এক জন বেশ বয়স্ক শাড়ি-পরা মহিলা, যাঁর মুখের উদ্বিগ্ন ভাব স্পষ্ট বলছে, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেছে। ঠিকই ধরেছিলাম, ওই বৃদ্ধকে খুঁজছেন। ‘মেটে রঙের হাতকাটা সোয়েটার পরা লম্বা মতো এক জন বুড়োমানুষকে দেখেছেন? আমার বাবা। কিছু ক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।... মা, তোমরা যে কী করো! দরজাটা খোলা রাখলে কেন?... জানেন, ওঁর হাই ডায়াবিটিস, হাই প্রেশার, ইনসুলিন চলছে। যে কোনও সময় রাস্তায় পড়ে যেতে পারেন...’ আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘এই রাস্তাটা ধরে যান, পারলে মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকানটাতে খোঁজ নিন।’ ‘মিষ্টি খেতে চাইছিল? কিন্তু বাবার তো সব বারণ, সমস্ত... তা ছাড়া বাবার কাছে তো... আপনার কাছে পয়সা চেয়েছে, না? উঃ, আর পারি না...’ |
|
|
|
|
|