|
|
|
|
|
|
|
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: স্বামী বিবেকানন্দ |
কৃষ্ণেন্দু সান্যাল |
এমন সোজা হয়ে বসে আছেন, তাঁর সামনে কুঁজো হয়ে নোট নিতে লজ্জা করছিল। তেজে গোটা ঘরটা কাঁপছে। সামনে ছড়ানো অনেক বই। ফরাসি সংগীতের ওপর বই আছে, ভ্রমণ, রান্নাবান্না, ন্যায়শাস্ত্রের ওপরেও। ক্লাসিকাল গান-বাজনার সিডি ইতস্তত ছড়ানো। আর একটা বড় মাপের খাতা। কিছু একটা লিখছেন হয়তো, নিবন্ধ বা গান, কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস হল না।
প্রতিবেদক: সার্ধশতবর্ষের ক্যালেন্ডারে তো নেক্সট সেলেব্রিটি আপনিই, আনন্দ হচ্ছে না?
বিবেকানন্দ: অবশ্যই! আমার চোদ্দো হাত ফোঁপরা কাট-আউটে ঝুড়ি ঝুড়ি গাঁদা-গোড়মালা প্যাঁচানো হবে, ক্লাবের মাঠে জংধরা ‘বিবেকানন্দ কাপ’ নিয়ে ভিক্ট্রি ল্যাপ দেওয়া হবে, যুবক-যুবতী পরস্পরকে ‘ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স অব সাউথ সিটি মল’ সম্বোধন করবে, আর আমার আনন্দ হবে না? একটাই শুধু টেনশন। ট্র্যাফিক সিগন্যালে আমার কোন গানটা তোরা বাজাবি, ‘খণ্ডন-ভব-বন্ধন’ না ‘নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর’।
প্রতি: না, মানে, এ ভাবে...
বিবেকানন্দ: এ ভাবেই আমি কথা বলি ভায়া, যখন প্রয়োজন মনে করি। এক বার বিদেশে আমায় এক মহিলা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদের দেশে নাকি মেয়ে জন্মালেই তাকে কুমিরের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?’ আমি তক্ষুনি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। সেই জন্যই তো এখন ভারতে প্রসবাদি কর্ম পুরুষদেরই করতে হচ্ছে।’
প্রতি: হা হা হা, ইয়ে, আপনি আমাদের এরম বলছেন বটে, আপনাকে কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরাও হেভি রেসপেক্ট করে।
বিবেকানন্দ: আমায় রেসপেক্ট করবে না? আমি একটা মাটিতে শুয়ে গোঙাতে থাকা জাতকে সিঙ্গলহ্যান্ডেডলি তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। ত্রিশ কোটি শিরদাঁড়ায় ইস্পাত ঠুকে বজ্র তৈরি করেছিলাম, একা। হীনম্মন্যতা বানানটাই উড়িয়ে দিয়েছিলাম অভিধান থেকে। সেটা অবশ্য এখনও বজায় আছে, তোরা একটা ‘ম’ দিয়ে লিখিস। আমি এক বার যা বলেছিলাম একটু কেটেছেঁটে তোকে বলি: আমি সমাজের ওপর বোমার মতন ফেটে পড়ব, আর সমাজ আমায় কুকুরের মতো অনুসরণ করবে।
প্রতি: স্যর, কথাটার শুরুটা নিয়ে সন্দেহই নেই। আপনি যে ভাবে ফেটে পড়েছিলেন, তার চেয়ে বড় বিস্ফোরণ আমাদের ইতিহাসে হয়নি। কিন্তু বাকি অর্ধেকটা নিয়ে একটু... মানে, সমাজ আপনাকে কুকুরের মতো অনুসরণ করেছে কি?
বিবেকানন্দ: না, মানতেই হবে, পুরোপুরি করেনি। কারণ এই সমাজের পেডিগ্রি নেই। আমি যাকে সেন্ট বার্নার্ড ভেবেছিলাম, এখন দেখছি সে লোমওঠা নেড়ি বই নয়। প্রভুকে অনুসরণ করে আগুনের মধ্যেও নির্ভয়ে চলে যায়, এমন আচ্ছা আচ্ছা কুকুর আছে। মহাপ্রস্থানে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যে গেছিল, তার কথা মনে কর। কিন্তু ঘিয়েভাজা কেঁউকেঁউ প্রাণীকে আমি ঘি খাওয়াব কী করে? একটা বাউল আসত আমাদের পাড়ায়। গাইত, ‘রাখিতে নারিনু প্রেমজল কাঁচা হাঁড়িতে’। |
|
বিবেকানন্দ, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে। |
প্রতি: স্যর, তা হলে আপনার ইয়েটা ব্যর্থ হল কি? মানে... কাজকম্ম?
বিবেকানন্দ: উফ, তোদের এই খণ্ডদর্শন দেখলে না, মাথা ঠিক রাখা শক্ত হয়ে পড়ে। আচ্ছা, আজ থেকে একশো বছরেরও আগে আমি ‘মাদ্রাজ টাইম্স’ কাগজের ইন্টারভিউয়ে কী বলেছিলাম একটু শোন। ‘জনগণকে অবহেলা করাই ভারতের প্রবল জাতীয় পাপ... যত রাজনীতিই করা যাক না কেন, তাতে কিছুই হবে না যত ক্ষণ না জনগণের উপযুক্ত শিক্ষা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং উন্নতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। জনগণ আমাদের শিক্ষার জন্য পয়সা দিয়েছে, মন্দির তৈরি করে দিয়েছে, বিনিময়ে চিরকাল লাথি খেয়েছে। তারা প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণের ক্রীতদাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তোরা একটাও আন্দোলনে একটাও কথা বলিস, যা এর বাইরে? এ রকম এক লাখ কোটেশন দেওয়া যায় অবশ্য।
প্রতি: তা বলছি না, কিন্তু চার পাশে তো...
বিবেকানন্দ: চার পাশ মানে কার চার পাশ? আমার কাছে ভারত যা, সম্ভবত তোর কাছে তা নয়। আমি গোটা দেশ ঘুরে বেড়িয়ে তবে দেশ সম্পর্কে আইডিয়া তৈরি করেছি রে ছোকরা, নিজের মা-মামা-মাসিকে দিয়েই দেশ তৈরি: এ কথা ভেবে একটা মধ্যবিত্ত অস্তিত্বকে ফাঁপিয়ে পুরো দেশের ওপর প্রোজেক্ট করিনি। সমস্ত দেখে, শুনে, এক এক ঘায়ে আমি হাজার বছরের কুসংস্কারকে গুঁড়ো করেছি। সন্ন্যাসী হয়ে বলেছি, ‘আমি বরং তোমাদের ঘোর নাস্তিক দেখতে চাই কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন নির্বোধ নয়।’ সন্ন্যাসী হয়ে বৈরাগ্যের চেয়ে মানুষের সেবাকে প্রায়োরিটি দিয়েছি। বনে-পাহাড়ে-কন্দরে থম মেরে থাকা মুনিঋষিগুলোকে সংসারে টেনে এনে তেড়ে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছি, হাসপাতালে, স্কুলকলেজে, মাঠেঘাটে। সবচেয়ে ঘেন্না করেছি কাঁদুনি গাওয়াকে। দীনাহীনা ভাবকে। এইগুলোই কি আধুনিক ভারতের ভিত্তি তৈরি করেনি? আমার কাছে ভারত কী জানিস? সে হল একটা দৈত্য যে জেগে ঘুমোয়। একই সঙ্গে সে হল, পাথরে পা দিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে পাহাড়ি নদী পেরোতে থাকা সেই গরিব মা, যে তার মধ্যেও ঘুরে ঘুরে পিঠে বাঁধা বাচ্চাকে আদর দিচ্ছে।
প্রতি: হ্যাঁ, তা... কী বললেন ঠিক বুঝলাম না। সেই ভারত কি আপনার কথাবার্তা শুনেছে?
বিবেকানন্দ: শোন বাপু, একটু সংক্ষেপে বলি। মূর্খের সঙ্গে আলাপ করার সময় নেই। প্রথমত, এক জন মনীষীর প্রভাব বহু স্তরে বয়ে চলে। নতুন পাতা দেখে প্রাচীন শেকড়ের স্বরূপ লে-ম্যান চিনতে পারে না। আদৌ যে স্বাধীন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিস এটাই আমার আগুনে দেশ না জাগলে হত কি না, ভেবে দেখিস। ভারত আজ বন্ধ চায় না, কাজ চায়। আমি বলেছিলাম, বরং অপরাধ করো, তবু চুপ করে বসে থেকো না। জপের মতো বলেছিলাম, ভয় ত্যাগ করো, ভেতরে তেজ আনো। আজ ছোট শহর থেকে কলার-তোলা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন উঠে আসছে তোদের টিমে। কোন যুগের পার থেকে কী ঢেউ দিয়েছি, আন্দাজ পাবি? দ্বিতীয়ত, ভোগবাদের দিকে ল্যা-ল্যা করা দেশ তো হালের ব্যাপার। দশ বছর আগে অবধি ভারত এমন ছিল না, হয়তো বিশ বছর বাদে আমূল পালটে যাবে। তাই, ঘটমান বর্তমানকে, এই মুহূর্তটাকেই, সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ভাবিস না। লীলা ও খেলা এখনও অনেক বাকি। তিন, কোটি কোটি লোক আছে, এবং রোজ সংখ্যায় বাড়ছে, আমার ছবি দেখে যারা নিজের মুঠোয় রক্ত-চনচন টের পায়। কেউ কেউ শীতকালে চান করতে যাওয়ার আগে অবধি এক বার তাকিয়ে নেয়।
প্রতি: তা হলে কেন রেগেমেগে বললেন, নেড়ি কুকুর? দেড়শো বছর নিয়ে ব্যঙ্গ করলেন...
বিবেকানন্দ: তার কারণ তোরা আমার তৈরি করা মিরাক্ল-এর জমিতে ঢ্যাঁড়স ফলাচ্ছিস। যে রান তুলে দিয়ে গেছিলাম, তাতে অ্যাদ্দিনে ট্রফি নিয়ে পিকনিকে চলে যাওয়া উচিত, আর তোরা লোপ্পা ক্যাচ ফেলে ম্যাচ ছেড়ে দিচ্ছিস। কেন জানিস? আয়নায় যখন তাকাস, নিজেকে শ্রদ্ধা করিস না। বলেছিলাম, এই দেশে ধর্মটা ভাত, বাকি সব তরকারি। তোরা ভারতে জন্মে তার মূল জোরটাকেই ইগনোর করছিস। এ যেন, সচিনকে বোলার হিসেবে টিমে নেওয়া। আমার সারা জীবনের কাজ আর কিস্যু না, একটা এক্সপেরিমেন্ট। রত্নাকর বাল্মীকি হলেন, সিদ্ধার্থ তথাগত। তবে যদুমধুডিকহ্যারি পারবে না? আলবাত পারবে, এই বিশ্বাস। নিজেকে যে বিশ্বাস করে না, সে-ই নাস্তিক। সেই বিশ্বাসটা তোদের মধ্যে জাগাবার মন্তর দিলাম, আর তোরা কম সুদে যে লোন দেয় সেই সংস্থাকে বিশ্বাস করে বসে থাকলি! |
|
|
|
|
|