|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
এত বড় একটা ভূখণ্ড। উপমহাদেশ। এত রকমের মানুষ, তাদের এত রকমের ভাষা। জাতীয়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অভ্যেস ও বদভ্যেস, রীতি, পোশাক। গানবাজনাতেও কত বৈচিত্র। ধ্রুপদী সংগীত তো হিন্দুস্তানি ও কর্নাটকি এই দুই ভাগে স্পষ্ট বিভক্ত। তেমনই পল্লিগীতি, লোকসংগীতের অজস্র আলাদা রূপ, সুরের ধাঁচা, বিশেষ বিশেষ স্বরের প্রয়োগ, তাল, ছন্দ। আমরা বাঙালিরা, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে পড়া সংস্কৃতিমান বাঙালিরা, কথায় কথায় বাউল-ভাটিয়ালি আওড়াই। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নানান শহুরে ব্যান্ড দেশি-বিদেশি নানান যন্ত্রের সঙ্গতে সেই সব গান গেয়ে-বাজিয়ে নাম করেন, টাকা করেন, বেশ করেন। কিন্তু হাঙ্গেরির সংগীতরচয়িতা ও পিয়ানোশিল্পী বেলা বার্টোক (১৮৮১-১৯৪৫) যেমন নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে হাঙ্গেরীয় পল্লিগীতির স্বরলিপি করে রেখেছিলেন, রেকর্ডিং-ও করেছিলেন সে যুগের অনুন্নত যন্ত্র দিয়ে, আমাদের দেশে কেউ তা করেননি। করে থাকলেও, খুব সীমিত ভাবে। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের উপমহাদেশ সংগীত ও স্বরলিপিকে এক জায়গায় আনতে পারেনি আজও। তার ফলে এক দিকে দেখা দিয়েছে ব্যাপক সাংগীতিক নিরক্ষরতা, অন্য দিকে বিস্মৃতি। স্বরলিপি লেখার রীতি না থাকায়, ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের দেশে, বিশেষ করে নগরসভ্যতার বাইরে, কী ধরনের সুর-তাল ছিল, গানবাজনার কাঠামো ও রূপগুলো কেমন ছিল, সেই ধারণা আমাদের সীমিত ও গোলমেলে। গুরুশিষ্য পরম্পরার দৌলতে ধ্রুপদ খেয়াল ও ঠুংরির বেশ কিছু ‘গান’ দীর্ঘকাল থেকে গেলেও কালের স্রোতে সেগুলির মধ্যে নতুন নতুন উপাদান ঢুকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ঘরানার হেরফেরেও ‘গান’-এর রূপে, এমনকী ‘কথা’তেও পার্থক্য লক্ষ করা গিয়েছে।
আমাদের ধ্রুপদী সংগীত স্বাধীন স্বরবিতান, তান-সরগম নির্ভর। রাগের রূপ বজায় রেখে শিল্পী তাঁর নিজের ভাবনা ও কল্পনা অনুযায়ী পরিবেশনার সামগ্রিকতায় নিজের অবদান রাখবেন, এটাই শিল্পীর কাছে শ্রোতার দাবি। পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সংগীত কম্পোজিশন-নির্ভর। তাই স্বরলিপি ছাড়া তা অসম্ভব। আমাদের ধ্রুপদী সংগীত কম্পোজিশন-নির্ভর নয়। রলাঁ বার্থের তত্ত্ব প্রয়োগ করলে আমাদের বরেণ্য শিল্পীরা ‘High Priests of Art.’ আসর শুরু করার সময়ে তাঁদের গান বা বাজনা শুনে বোঝার উপায় থাকে না এই আসরে তাঁরা আমাদের কোন পথে নিয়ে যাবেন, আঙ্গিকের কাহিনিটি কী ভাবে পর্যায়ক্রমে মেলে ধরবেন। এইখানেই আমাদের ধ্রুপদী সংগীতের আলাদা রোমাঞ্চ। অজানা, অশ্রুতপূর্ব স্বরপরম্পরা, কিসিম, ধ্বনি ও ছন্দের খেলায় শামিল হওয়ার অ্যাডভেঞ্চার। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
আমীর খান, আলি আকবর খান ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (আজকাল আমাদের দেশে অর্বাচীন সাঁইয়ামাইয়াতেরেকেটেওয়ালার নামের আগেও ওস্তাদ আর পণ্ডিত লেখা ও বলা হয় বলে আমি যাঁদের প্রকৃত বরণীয় শিল্পী মনে করি, তাঁদের নামের আগে আর ও-সব লিখতে চাই না) অনুষ্ঠান পর পর দু’দিন শুনলেও এবং দু’দিন তাঁরা একই রাগ পরিবেশন করলেও টের পাওয়া যেত, নতুন কিছু খবর আমরা পাচ্ছি। যে সংগীত সম্পূর্ণ কম্পোজিশন-নির্ভর, তার বেলা এই নতুন খবর পাওয়ার উপায়টা অন্য রকম। সেখানে কন্ডাকটর একটা গোটা রচনার যে পাঠ নেন, সেইমত পরিবেশনার আঙ্গিকে সীমিত ভাবে হলেও কিছু স্বকীয়তা দেখাতে পারেন। কিন্তু নিতান্তই তাঁর নেওয়া পাঠের ভিত্তিতে, ইন্টারপ্রিটেশনের ভিত্তিতে। কল্পনার ডানায় ভর করে নয়। অনুমোদিত স্বরসমষ্টির এক্তিয়ারে কল্পনার আশ্রয় নিতে পারা, বিচিত্র স্বরপরম্পরা তাল-ছন্দ-লয়ের যোগাযোগের অভিনব ধ্বনিচিত্র আঁকতে পারা হল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের বিরাট এক বৈশিষ্ট্য। যার সঙ্গে ‘জ্যাজ’-এর কিছু মিল। জ্যাজের গোটা পরিবেশনা নিছক কম্পোশিজন-নির্ভর হয় না। সেখানে শিল্পীদের নিজস্ব কল্পনা ও মুনশিয়ানার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ থাকে।
উল্লেখযোগ্য হল, সারা দুনিয়ার পল্লিগীতি ও লোকগীতিতেও শিল্পীরা চিরকাল কিছু-না-কিছু স্বাধীনতা নিয়ে এসেছেন, স্বকীয় ভাবনা ও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। লালন শাহ্-র গান তিনি নিজে যে-ভাবে গেয়েছেন, তাঁর আমলেই অন্য কোনও লালনখ্যাপা বাউল কি গেয়েছেন হুবহু সেই ভাবেই? তা ছাড়া, এটাও তো হয়ে থাকা সম্ভব যে, লালন নিজেই হয়তো কোনও কোনও সময়ে গাইতে গাইতে কোথাও একটু অন্য রকম করে দিলেন, এমন একটা পর্দা লাগিয়ে দিলেন, যা তিনি আগে দেননি। সেই সময়ে বা তার কিছু কাল পরেও কোনও বেলা বার্টোক যদি গ্রামে ঘুরে ঘুরে গানগুলির স্বরলিপি করে রাখতেন, বাউলরা যে-ভাবে গাইছেন তার ভিত্তিতে, তা হলে আমাদের হাতে প্রামাণিক কিছু থাকত। তা সত্ত্বেও কালক্রমে গানগুলি হয়তো এখানে-ওখানে সামান্য হলেও পালটে যেত। সংগীত, মানুষ, সমাজ ও ইতিহাসের তো সেটাই বরাত।
স্বরলিপি না থাকায় আমাদের দেশের সংগীত ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কেউ কেউ বলবেন, তা কেন, আমাদের সংগীতবিদ্যা তো গুরুমুখী। গুরুর মুখে শুনে শুনে ছাত্রছাত্রীরা চিরকাল শিখে যাবে। দীর্ঘকাল সেটাই হয়েছে। বাদ সেধেছে চলতি যুগ ও তার হালচাল। ভাল শিক্ষক এখন পাওয়া ভার। সংগীতশিক্ষক হিসেবে যে-সে বাজারে নেমে পড়েছে। কোনও কোনও নবীন শিল্পী আবার গানের বাজারে একটু নাম করে গিয়ে শিক্ষকতা করতে শুরু করেছেন। এঁদের কাছেই অনেকে যাচ্ছেন গান শিখতে। যা শিখছেন, তার নমুনা আমরা টেলিভিশন চ্যানেলে-চ্যানেলে পাচ্ছি। সকলেই এখন গায়ক-গায়িকা, সকলেই গীতিকার-সুরকার, যেন শিক্ষার, দক্ষতা অর্জনের কোনও প্রয়োজনই নেই বাংলা গানের ক্ষেত্রে।
স্বরলিপি করে রাখার রীতি থাকলেই যে কোনও গানের ঐতিহ্য সুরক্ষিত হবে, তার স্থিরতা নেই; অন্তত আমাদের বাংলায়। রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর থেকে বিজ্ঞাপন-গান থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশির ভাগ এমন ভাবে, যেন তাঁর গান নিয়ে যথেচ্ছাচার না করলে আমাদের ফাঁসি হবে বা মাওবাদী হিসেবে জেলে পচতে হবে। একটি বাংলা ছায়াছবিতে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটির সঙ্গে ‘হুল্লা হুল্লা’ ধ্বনি প্রযুক্ত হওয়ায় আমি কয়েক জন শিক্ষিত বাঙালি তরুণের কাছে কারণটা জানতে চেয়েছিলাম। তাঁদের কেউ কেউ আবার ছবিও করেন, অভিনয় করেন। উত্তর পেলাম কেন? ‘পাগলা হাওয়া’, ‘পাগল আমার মন’ এই সব কথা তো মূল গানেই আছে। পাগলা আর পাগল আছে, সুতরাং হুল্লা হুল্লা হুপ্ হুপ্। একই যুক্তিতে তা হলে ‘পাখি বলে চাঁপা’ গানটিতে কাক-সমেত নানা রকমের পাখির ডাক জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। সংগীতে অশিক্ষিত, অদক্ষ, বেরসিক ও সাংস্কৃতিক গুন্ডাদের রাজত্ব প্রায় কায়েম হয়ে যাওয়ায় যা যা হওয়ার, হচ্ছে তাই-ই। কথায় কথায় আমরা যাঁদের উদাহরণ দিই, সেই সাহেবদের দেশে কেউ এক বার চেষ্টা করে দেখুন তো শুবার্টের আর্টসং, গার্শ্উইনের সুর করা গান, বের্টোল্ট ব্রেশ্টের লেখা কুর্ট ও ভাইল বা হান্স আইজ্লারের সুর করা গান নিয়ে সমকালীন বাঙালিসুলভ যথেচ্ছাচার করতে! স্বরলিপি থেকে নড়তে পারবেন না কেউ। মূল সুর নিয়ে বা মূল সুরের সঙ্গে নিজেদের খামখেয়াল জুড়ে কোনও গান রেকর্ড করা বা সেই গান কোনও ছায়াছবিতে প্রয়োগ করার কথা কেউ ভাবতেও পারবেন না। আর তার দরকারই বা কী। প্রয়োজন মতো নতুন গান বানিয়ে নিলেই তো হয়। |
|
|
|
|
|