|
|
|
|
|
|
|
জন্ম মৃত্যু বডি মাসাজ |
খবরের কাগজ থেকে তাকিয়ে থাকে সারি সারি ছোট্ট বিজ্ঞাপন। তারা সংবাদের চেয়ে
অনেক গুণ আকর্ষক, হয়তো অনেক গুণ সত্যগর্ভ। লিখছেন শিশির রায়
|
ভাড়াটে উঠছে না? স্বামী পরনারীতে বশীভূত? ঋণের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন? ‘বীনা রত্নে স্থায়ীভাবে গুপ্ত শত্রু দমনের মোক্ষম দাওয়াই এর জন্য আসুন। ৩ মিনিটে বশীকরণ, ৩৫০ বছরের বংশ পরম্পরায় জ্যোতিষী। ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষনি স্বাহা। দক্ষিনা ৫০১ টাকা।’ আপনার বিশ্বাসের আসন থাকুক কি টলুক, জগৎ জুড়ে বেবাক যুক্তিবাদী আঁতেল যাচ্ছেতাই বলুক, শ্রী অমুক শাস্ত্রী আচার্য দেব ব্র্যাকেটে আদিরা সৃষ্টির অন্ত অবধি পাতাজোড়া বিরাজ করবেন। খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতায়। আর রবিবারের শ্রেণিবদ্ধ লিস্টিতে। যে কোনও সংবাদের চেয়ে, সমাজ-ওথলানো হেডলাইনের চেয়ে, হাজার গুণ আকর্ষণীয়, সংক্ষিপ্ত এবং সম্ভবত সত্যগর্ভ এই বিজ্ঞাপনেরা। ধর্ম বলতে এখানে হাতে-গরম টাকা-প্রেম-শান্তি পাইয়ে দেওয়ার আজব কল। হাইলাইটেড অক্ষরে আপনার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে সিদ্ধ চমৎকারী আংটি, ধনদা বিংশাক্ষর সৌভাগ্য সিদ্ধি কবজ (কবচ নয়), বগলামুখী প্রাতঙ্গিরা, সন্তান গোপাল যন্ত্রম (গর্ভ রক্ষা করে সুখে প্রসব করায়)। আর টেক-স্যাভি আপনি আইফোন-ফাইভ হাতে তুলে নিয়ে ফোন করবেন মহান তান্ত্রিক বশীকরণ সম্রাট, একই অঙ্গে বহুরূপী অ্যাস্ট্রাল জ্যোতিষী বাস্তুবিদ ফেস রিডার ফেং শুই গুরু সিদ্ধাই বাবাকে-- যিনি মুখ হাত জন্মছক দেখে (বা না দেখেই) যা বলেন, ফলে অক্ষরে অক্ষরে। ‘এক ফোনেতে বাজিমাত, প্রেম সমস্যা কুপকাত।’ কাঁথি মেচেদা বহরমপুর চুঁচুড়া বালি বাগুইআটি। ডাকযোগেও প্রতিকার হয়।
কিছু মানুষ হারিয়ে যান। ভিড়ে, মেলায় গিয়ে, স্টেশনে হঠাৎ, বা এমনিই, একা একাই। এঁরা জীবনে হেডলাইন হতে পারেন না। কিন্তু বিজ্ঞাপনের মুখ হয়ে থেকে যান। নিজেরা জানেন কি আদৌ, ছবি ছাপা হয়েছে তাঁদের? কিছু অস্পষ্ট, ভাবলেশহীন মুখ, তেল না-পড়া উসকোখুসকো চুল, ফ্যালফেলে চোখ তাকিয়ে থাকে কাগজের পাতা থেকে। এঁরা মানসিক ভারসাম্যহীন। অমল ব্যানার্জী (খোকা), বয়স ৬৭, ৩০শে জুলাই থেকে নিরুদ্দেশ। সুধাময়ী কেরকেট্টা ভোর পাঁচটায় এয়ারপোর্ট দু’নম্বর গেটে হাঁটতে গিয়ে আর ফেরেননি। ৭৪ ফর্সা রোগাটে মাথার তালুতে কালো দাগ। যদি কেউ উক্ত ব্যক্তির সন্ধান পান... কত দিন হলো বাড়ি ফিরিসনি স্বপ্নিল বেরা, মা শয্যাশায়ী, এখনই ফিরে আয়। পরনে ছিল নীল বারমুডা কালো-হলুদ বাটিক প্রিন্টের পাঞ্জাবি।
পাশের কলামে চোখ যেতেই, উলি বাবা লে। একের পর এক খুদে বিচ্ছু সুন্টুমুনুদের ড্যাবাড্যাবা চোখ, হাসি-হাসি বা প্রবল বিরক্ত মুখ। হোক না জন্মদিন বা অন্নপ্রাশন, ছবি তোলার সময় তো আর বলে-কয়ে তোলেনি। টিশান ভুতুসোনার প্রথম জন্মদিনে অনেক আদর। মাম্মাম বাবা পিপি নানুরা ভাইয়া শম্পিমাসি লঙ্কাবুড়ি মিমি মেমো। কত জনের উজাড় করা সুঘ্রাণ কচি বুমবুড়ির জন্য। কখনও কাঁচা হাতের ছন্দ: দুষ্টুসোনা দুষ্টুমিভরা পাঁচটি বছর করে দিলি পার। এই দিনটি তোর জীবনে আসুক অনেক অনেক বার। প্রিয়াঙ্কার আগামী ২৩শে হবে বারো, দিনে দিনে আরও অনেক বাড়ো। শুভেচ্ছা-বার্তা আছে বড়দের জন্যও। প্রবচন-ব্যবহার লক্ষণীয়: ‘পাখীক পাখ মীনক পানি। জীবক জীবন হাম ঐছে জানি। শুভ আবির্ভাব দিবসের শুভেচ্ছা।’ অথবা, সারা দুনিয়াকে জানিয়েও প্রেমের গোপনীয়তা রক্ষা: ‘পাগলি, আই লাভ ইউ। তোমার জন্মদিনে বুকভরা ভালবাসা। পচা সিং।’ |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
পাশেই আবার সারি সারি মুখ। গম্ভীর, সহাস্য, নির্বিকার, প্রশান্ত। শিরোনাম ওপরে: স্মৃতির উদ্দেশে। ‘আজ তিন বৎসর হল তুমি নাই। আমার কর্মব্যস্ততা নাই, এক বার বল তুমি ভাল আছ, তাতেই শান্তি।’ ‘তোমার অকাল মৃত্যুতে অপপ্রচারকারী অমানুষদের ক্ষমা করিও না।’ যেন পাশের ঘর থেকে বলা: ‘শুনছ তোমার বাবু আমার ট্যাংরা ভাল ভাবে পাশ করেছে।’ জিভ বের করে পোজ-দেওয়া কুকুরের ছবি। লেখা: ‘ন্যান্সি। আসা: ১২ই অক্টোবর ২০০০। যাওয়া: ২১শে জুন ২০১২। ভাল থাকিস, মা।’ কোথা থেকে ভেসে আসে সুরেলা মৃদু ঘেউ। বেশির ভাগ স্মরণ-বার্তায় অনিবার্য রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি। নয়ন সমুখে তুমি নাই। যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু...। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ: ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া... অবনী, বাড়ি আছো? না, অবনী তালুকদার আর নেই...।’ শোক প্রকাশের অসতর্ক বয়ানে কখনও তৈরি হয় হাস্যরস: ‘আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে দুঃখের সঙ্গে তোমার স্মৃতি ও বিচক্ষণতা স্মরণ করি।’ কখনও বিজ্ঞাপন যেন আঁকড়ে ধরা খড়কুটো। ‘ম্যাডাম, আজ তোমার ত্রিশতম জন্মদিনে তোমার ছবি নিয়ে বসে আছি ক্ষতবিক্ষত একা।’ ‘পত্রমিতালি’ শিরোনামে শরীরী খেলার ইশারা। পিঙ্কি, তামান্না, কাজল, মুন্নি, সামান্থা, সিমরান। ‘এ ওয়ান বডি মাসাজ। এক্সেলেন্ট হার্বাল মাসাজ বাই বিউটিফুল প্রোফাইল। ফুল রিল্যাক্স, সেফ এরিয়া, এসি পার্কিং।’ তিলোত্তমা কলকাতায় নতুন? এনজয় থ্রু ডে/নাইট প্রফেশনাল এসকর্ট সার্ভিস। গুডলুকিং বডিবিল্ডার, ফোর বয়েজ নিউ। বন্ধু না হলে ফি ফেরত, ঠকবার ভয় নেই। বোল্ড রিলেশনের মাধ্যমে ইনকাম ১৫০০০-২৫০০০। প্রতিষ্ঠিত যুবক (৩৪), সুগভীর বন্ধুত্বের জন্য বড় ঘরের মহিলারা যোগাযোগ করুন। প্রতিষ্ঠিত যে যুবক, কী চাইবে সে, কেন? বড় ঘরের মহিলা কেন? ওঁরাই সব থেকে অসহায়, ভালবাসার, স্পর্শের কাঙাল বুঝি? আর মধ্যবিত্ত, ছোট ঘর? সাধ নেই, না কি সাধ্য? সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা সুমিত্র চাই। ব্যবসায়ী ৪০ বিবাহিত নিঃসঙ্গ, সাক্ষাতেচ্ছু ভ্রমণেচ্ছু বান্ধবী/বন্ধু চাই। বিবাহিত, নিঃসঙ্গ? কেন? ছেলেপুলে নেই? সাধ-আহ্লাদ মেটানোর, কথা বলার, আদর করার কেউ? ওরা বিজ্ঞাপন, উত্তর দেবে না। হয়তো জুটিয়ে দেবে কাউকে।
আরও কত কী বাকি থেকে যায়। বেলেঘাটায় রিটায়ার্ড ব্যাঙ্ক কর্মী, শহর থেকে দূরে যে কোনও জায়গায় বাড়ি/জমি দেখাশোনা করার জন্য থাকতে চাই। বাষট্টি বছরের এক্স-জ্যাভেরিয়ান আজ আশ্রয়প্রার্থী, যে কোনও কাজ দিলে সানন্দে করবেন। এই মানুষেরা কেন নিরাশ্রয়, সম্বলহীন? পাশের কলামে শহরতলির বৃদ্ধাশ্রমের বিজ্ঞাপন কী এক ছলছল মমতায়, করুণায় চেয়ে থাকে। তার ও-পাশে ‘স্বাস্থ্যবতী, পঁচিশের কমবয়সী, বিবাহিতা, এক সন্তানের মা, ডিম্বাণুদাতা হিসাবে সাহায্য করিলে কৃতজ্ঞ থাকিব।’ কোনও নারী কি দেখেছেন, নিজের ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ভেবেছেন, যিনি দিয়েছেন এই বিজ্ঞাপন, তাঁর কথা, তাঁর গৃহশান্তির কথা? না কি তিনি আপনিই, অলস দুপুরে কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক ঝলক দেখেই সরিয়ে নিয়েছেন চোখ সেই মর্মান্তিক বিজ্ঞাপন থেকে : ‘আমার বারো বছরের মেয়ের দুইটি কিডনী অক্ষম। সহৃদয় o+ কিডনী দাতা অবিলম্বে চাই। আমি দোকানে খাতা লিখি... ।’ শব্দ, অক্ষরেরা যানজটের মতো ভিড় করে আসে। মুড়িভাজা ও অন্যান্য মেশিনের জন্য আসুন জগদম্বা ট্রেডিং, মেদাসুরকে বিনাশ করুন হার্বাল টনিক দিয়ে, ‘স্টে অন’ ক্যাপসুল অ্যান্ড অয়েল, ‘মিরাকুল’ ব্যথানাশক তেল, কোরিয়ান টেকনলজির হেয়ার ইমপ্ল্যান্টে টাক সমস্যার তাক লাগানো সমাধান, দাদ-হাজা-চুলকানির ‘জালিম লোশন’। জাদুকর বি সি সেনের গুজরাতের ট্যুর বাইশে ডিসেম্বর বেরোবে। তাঁর পার্টিতে স্টেজ অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য কম বয়সের স্মার্ট অবিবাহিত তরুণ তরুণী চাই। উন্নত জাতের রোগহীন কুকুরছানা বিক্রয় আছে। লাফিং ক্লাবে ইনস্ট্রাক্টর চাই। আমি অনিল পরামানিক বারাসত কোর্টে এফিডেভিট বলে অদ্য হইতে অনিল দাস হইলাম, রাজু রাজপুত ও রাজেশ রাজপুত একই ব্যক্তি...। পুরনো নাম মুছে ফ্যালে কত মানুষ। কিন্তু স্মৃতি মোছে না। ফিরে আসে, বিজ্ঞাপন হয়ে। ‘বরিশাল জেলা লতা গ্রাম স্কুলের ১৯৪৬-১৯৪৯ রীনা তৃপ্তি তুষার মৃণাল খনা নিভা সুবোধ জ্যোৎস্না মঞ্জু লীলার দর্শন চাই। বাল্যবন্ধু। ফোন করিস... ’ |
|
|
|
|
|