প্রধানমন্ত্রী যুক্তিতর্কের পথে সব সমস্যার সমাধান খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু যে যায় ক্ষমতায়, সে-ই তো বিপক্ষের কথা শুনতে ভুলে যায়।
তর্কটা হবে কী করে? প্রশ্ন তুলেছেন
অশোককুমার মুখোপাধ্যায় |
শততম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছেন, সমাজের সব জটিল সমস্যাগুলির, সে জিন-পরিবর্তিত খাদ্যই হোক বা পরমাণু বিদ্যুৎই হোক, সমাধান করতে হবে যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের পথে। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিতর্ক আর সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। আবেগ-বিশ্বাস-ভয় দিয়ে জটিল সমস্যার নিষ্পত্তি হবে না। এবং, শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বাড়ি-কর্মস্থল-পাড়া সর্বত্র যুক্তি তথা বিজ্ঞানের প্রসারে বিনিয়োগ করতে হবে।
দামি কথা। একশো কুড়ি কোটি মানুষের যে দেশে রাজনৈতিক নির্বাচন ব্যবস্থাটি চলে আবেগ-বিশ্বাস-ভয় দিয়ে, যে দেশের বহু মানুষের এখনও কবজ-তাবিজ-পাথরের অলৌকিক ক্ষমতায় তর্কাতীত বিশ্বাস, সেখানে এমন যুক্তির কথা খুব জরুরি। যাঁরা যুক্তির পথে থাকতে পারেন, তাঁরা সাহসী। যেমন ডিরোজিয়ো। উৎপল দত্তর নাটকে দেখি, যুক্তির কথায় ক্ষমতাবান লোকটি রেগে গিয়ে ডিরোজিয়োকে চড় মারল। তাঁর শিষ্যরা প্রত্যাঘাত করতে তৈরি। ডিরোজিয়ো দু’হাত তুলে ওদের থামতে বলে, লোকটির উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বললেন, এতে কী প্রমাণিত হল? আপনি এক জন গুন্ডা, যুক্তিবাদী নন।
যে রাজ্যে দাঁড়িয়ে শ্রীসিংহ এই কথা বলেছেন, সেই রাজ্যের এক জন রসায়নের ছাত্র এবং সাহিত্যিক রাজশেখর বসু লিখেছিলেন, ‘যিনি বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবক, তিনি ধীর ভাবে ভ্রমপ্রমাদ যথাসাধ্য পরিহার ক’রে সত্যের সন্ধান করেন, প্রবাদকে প্রমাণ মনে করেন না, প্রচুর প্রমাণ না পেলে কোনও নূতন সিদ্ধান্ত মানেন না, অন্য বিজ্ঞানীর ভিন্ন মত থাকলে অসহিষ্ণু হন না, এবং সুপ্রচলিত মতও অন্ধ ভাবে আঁকড়ে থাকেন না, উপযুক্ত প্রমাণ পেলেই বিনা দ্বিধায় মত বদলাতে পারেন। জগতের শিক্ষিত জন যদি সকল ক্ষেত্রে এই প্রকার উদার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি প্রয়োগ করতে শেখেন, তবে কেবল সাধারণ ভ্রান্ত সংস্কার দূর হবে না, ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষেরও অবসান হবে।’ |
অতীত? লালবাজারের বন্ধ দরজার সামনে। ১১ নভেম্বর, ২০০৭ |
আর এক চিন্তাবিদ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বৈজ্ঞানিক চিন্তার সমর্থনে বলছেন, ‘কোন একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা প্রকৃত কিনা এবং ঘটনাটা প্রকৃত কিনা তাহা জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম করিতে হয়।... অবৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানবিদের এইখানে পার্থক্য।’ সুকুমার রায় লিখছেন, ‘কতগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে তখন তাহার প্রভাব কত দূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সবচাইতে বড় দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ। এতবড় সর্বগ্রাসী জুজু এ দেশে বা কোনো দেশে আর দ্বিতীয় নাই।... যে সত্যকে সত্যরূপে দেখিতে গেলে মানুষের পৌরুষবুদ্ধিকে খোয়াইতে হয়, তবে সে সত্যবঞ্চিত অক্ষম পৌরুষ আমার কোন কর্মে লাগিবে?’
রামমোহন-ডিরোজিয়ো থেকে বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথ বসু সবাই অন্ধতা, অযুক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন। ‘উগ্র বামদের’ নেতা মাও জে দংও বহুমতের গুরুত্ব বুঝতেন। সেই কারণেই বলেছিলেন, শত ফুল ফুটুক, শত মতাদর্শ দ্বন্দ্বে মাতুক। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন রকমের মতাদর্শের তর্ককে আবাহন করেছেন। বলেছেন, এর থেকেই সত্য বেরিয়ে আসবে। সঠিক মতাদর্শকে আড়াল-আতুপুতু করে রাখার দরকার নেই। তাকে ছেড়ে দাও বিভিন্ন মতাদর্শের মুখে। এদের সঙ্গে যুক্তির লড়াইয়ে সঠিক মতাদর্শটি, প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পর, আরও পোড় খেয়ে সত্য হয়ে ফুটবে।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী কোনও নতুন কথা বলেননি, যুগে যুগে বিভিন্ন জনের বলা কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। এবং এই যুক্তির লড়াইয়ের জন্য কী দরকার, সেটাও বলেছেন স্পষ্ট ভাবে। তাঁর বক্তব্য, যথাযথ সুশৃঙ্খল তর্কবিতর্ক (স্ট্রাকচারড ডিবেট) চালাতে গেলে দুই পক্ষকেই সহিষ্ণু হতে হবে। যে কোনও বিতর্কের এটাই প্রাথমিক শর্ত।
গোলমালটা এখানেই। গত চার দশক, বিশেষত বিগত এক দশকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হল অসহিষ্ণুতার ইতিহাস। যে যখন ক্ষমতায়, বিরুদ্ধ যুক্তি শুনতে চায় না। বিরোধী মানেই যেন দেশের শত্রু, প্রতিক্রিয়ার শক্তি!
কয়েক বছর আগেই এ রাজ্যে বামফ্রন্টের ধরন ছিল: বিরোধীরা আমাদের তুলনায় নগণ্য, অতএব ওদের কথা শোনার দরকার নেই। এর ফলেই সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় সমস্যার উদ্ভব। এর বিরুদ্ধে লড়ে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এল। এখন নতুন মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে এক ছাত্রীর ‘বেয়াড়া’ প্রশ্ন শুনে বা লালগড়ে এক যুবকের অভিযোগ শুনেই তাদের মাওবাদী বলে চিহ্নিত করেন, তখন কি যুক্তির ওপর তাঁর আস্থা প্রমাণিত হয়?
রাজ্যে যে ছবি, কেন্দ্রেও তা-ই। ক’দিন আগেই ইন্ডিয়া গেটের উতরোল প্রতিবাদীদের কাছে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা না-বলার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্ন ছুড়লেন, ওখানে যদি বিজেপি কোনও প্রতিবাদ প্রদর্শন করে বা মাওবাদীরা কোনও বিক্ষোভ-আন্দোলন করে তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কেন ওইখানে যেতে হবে? যেখানে দরকার প্রতিবাদীদের মুখোমুখি হয়ে, তাদের যুক্তি-অভিযোগ শুনে দ্রুত ব্যবস্থাদি নেওয়া, সেখানে তিনি তাদেরই দুরমুশ করার ব্যবস্থা নিলেন। এবং ওই কথাটিতেই ধরা পড়ল একটা অসহিষ্ণু রাষ্ট্রের মন। প্রতিবাদীরা মাওবাদী হলেই বা তাদের সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি কোথায়? বিরুদ্ধ মত শোনায় কেন এত অনীহা? উনি তো ‘নানা ভাষা নানা মত’ ভারতবর্ষের স্বরাষ্ট্র দফতরের মাথা। কিন্তু মন্ত্রী এমন ভাব দেখালেন যেন কংগ্রেসের রাজনীতিই রাষ্ট্রের রাজনীতি। বাকি সব প্রতিক্রিয়া।
এই অসহিষ্ণুতাকে সরিয়ে ‘যথাযথ বিতর্ক’-কে সম্মান দিলে তো ভালই হয়। আমরা যুক্তির নির্ভরে বুঝতে শিখি পরমাণু বিদ্যুৎ রাজ্যের পক্ষে ভাল না খারাপ? অথবা জিন-পরিবর্তিত খাদ্য এই স্বাস্থ্য-বিপন্ন রাজ্যবাসীর ওপর আর একটি অভিশাপ না আশীর্বাদ? সম্যক বুঝতে শিখি, বিভিন্ন পরিষেবায় বিদেশি বিনিয়োগে দেশের লাভ না ক্ষতি? পরিবহণ ব্যবস্থা সচল রাখতে কেনই বা ভাড়াবৃদ্ধি জরুরি?
কিন্তু ওই পরমতসহিষ্ণু আবহাওয়া গড়ে উঠবে কী ভাবে? প্রধানমন্ত্রীর দলসহ কোনও রাজনৈতিক দলের আচরণে তো সেই সহিষ্ণু মনোভাব ধরা পড়েনি! |