এ কথা সকলেই জানেন যে মোবাইল ফোন প্রাণ অপেক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বহু সোপান পার হইয়া মানুষ এত দিনে উপনীত হইয়াছে সেই চরম সাফল্য-শিখরে, যখন নিজ আত্মার অধিক সমাদর সে করিতে শিখিয়াছে তাহারই এক আবিষ্কারকে। মোবাইলাশ্লেষের জন্য সে সব ছাড়িতে পারে: লৌকিকতা, ভদ্রতা, সুস্থতা। বহু লোক রাস্তা পার হইতে হইতে বা গাড়ি চালাইতে চালাইতে কেবল মোবাইলে কথা বলেন না, তাহার পর্দায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া মেসেজ অবধি করেন। রেললাইন ধরিয়া হাঁটার সময় তো মোবাইলে কথা বলিবার তাড়নায় অনেকে রেলগাড়ি সম্পর্কে সতর্ক থাকিবার প্রয়োজন বিস্মৃত হন। তবে মোবাইলের ব্যবহার সর্বাপেক্ষা অধিক ঘটে সম্ভবত নাটক বা সিনেমা চলাকালীন। চুপ করিয়া বসিয়া থাকার অপর নামই মোবাইলে খুটখাট করা, বিশাল আয়তক্ষেত্রের নীল উজ্জ্বল আলো জ্বালাইয়া খোঁজ লওয়া গত দেড় সেকেন্ডে কে আপনার সহিত যোগাযোগ করিতে চাহিল। প্রতিটি অনুষ্ঠানের সূচনালগ্নে ঘোষণা করিয়া ও বিজ্ঞপ্তি দর্শাইয়া কোনও লাভ হয় না, পার্শ্ববর্তী দর্শক বারংবার বিরক্তিসূচক শব্দ করিলেও ফোনক্রীড়া থামিবার নহে। মোবাইল এখন কেবল ফোন নহে, তাহা কম্পিউটার বিশেষ, তাহার মাধ্যমে মতামত সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ ছড়াইয়া দেওয়া যায়, এই মুহূর্তে ঘাম হইতেছে কি না বা মূত্রের বেগ আসিল কি না, তাহা সহস্রাধিক ভার্চুয়াল মিত্রকে না জানাইতে পারিলে আর প্রাণ রাখিয়াই বা কী হইবে। সম্ভবত ভবিতব্যকে মানিয়া লইয়া, তাহাকে পীড়াদায়ক স্ফোটকের পরিবর্তে নিজ জোরের জায়গায় রূপান্তরিত করার তাড়নায়, কয়েকটি মার্কিন প্রেক্ষাগৃহ কিছু আসন পৃথক করিয়া দিল, যেখানে বসিয়া নাটক সম্পর্কে অনবরত মোবাইলে ‘টুইট’ করা যাইবে।
একদা পাশ্চাত্যে বহু ব্যান্ড-জলসায় বেআইনি ভাবে গান যন্ত্রস্থ করিয়া লইত শ্রোতা-দর্শকগণ, ওইগুলিই শুনিত, রেকর্ড কিনিত না। এই লইয়া বহু অশান্তি হইবার পর, কিছু ব্যান্ড সরাসরি এই অভ্যাসকে সাধুবাদ জানায়, তাহারা বলে, এই ভাবেই তাহাদের গান সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ুক। এবং সত্যই কিছু প্রথাবিরোধী সংগীত-আন্দোলন এই পদ্ধতির মাধ্যমে আশাতীত জনপ্রিয়তা লাভ করে। হয়তো এই পথ অনুসরণ করিয়াই, স্মার্টফোন আসিয়া করতলে আন্তর্জালের সুবিধা আনিয়া দিবার পর, আমেরিকার কিছু প্রেক্ষাগৃহ যুগ-দাবিকে স্বাগত জানাইয়া ‘টুইট সিট’-এর ব্যবস্থা করিল। কেহ বলিয়াছেন, এই জীবন্ত প্রতিক্রিয়ার স্রোতে নাটকটিও সমৃদ্ধ হইবে, কারণ নাট্য চলাকালীন তাহার সম্পর্কে উত্তেজনাপূর্ণ মন্তব্য ও আলোচনা শুরু হইয়া গেলে, উহা চমৎকার রিভিউ হিসাবে কাজ করিবে। হয়তো অভিনেতাগণ একটি সংলাপ তৎক্ষণাৎ বানাইয়া বলিবেন, যাহাতে তাহা লইয়া তন্মুহূর্তে টুইট-ঝড় শুরু হইতে পারে। দর্শকের সহিত অভিনয়ের এক স্পষ্ট সেতু গড়িয়া তুলিবে টুইটাসন। কেহ ইহার বিরুদ্ধে বলিয়াছেন, প্রকৃত আলোচনা টুইট-এ হয় না, নিতান্ত অন্তঃসারশূন্য কিছু পঙ্ক্তি লেখা হয়, কারণ যে মানুষ নাটকের দৃশ্যটি না দেখিয়া লিখিতে ব্যস্ত, তাহার আলোচক-সুলভ হৃদয়বৃত্তি নাই, ফ্যাশনদুরস্ত হইয়া উঠিবার আগ্রহ আছে মাত্র। ইদানীং একটি গোষ্ঠী জন্মাইয়াছে, ‘লাইফ-লগার’, তাহারা মনে করে, জীবনের সকল খুঁটিনাটি প্রতি মুহূর্তে লিখিয়া রাখিলে পরবর্তী কালে তাহা ইতিহাসচর্চার অসামান্য উপাদান হইবে, তাই তাহারা ডিজিটাল বয়ানে ক্রমাগত নিজ জীবনের অনুপুঙ্খ নথিবদ্ধ করিয়া চলে। এই প্রবণতারই ভ্রাতা: শিল্প ভোগ করিতে করিতেই সেই সাক্ষ্যের ঘটনা ঘোষণা ও টিপ্পনী প্রদান। ইহাকে অমনোযোগীর আত্মগুরুত্ব-ব্যায়ামই বলা হউক বা প্রযুক্তি ও চিন্তাতরঙ্গের সফল বিবাহ, এই বন্যা রোধ করিবার সাধ্য কাহারও নাই। সে ক্ষেত্রে, অন্তত রক্ষণশীল নাট্য-দর্শন যে নব্য ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র বসিতে পাইয়া বহমান বিপ্লবের দংশন এড়াইল, ইহাই বা কম কীসে! |