বড় বড় বিজ্ঞান-প্রকল্পে মেধাবী গবেষকের অভাব। এবং সে জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দায়ী করলেন এক বিজ্ঞানী। বললেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিদ্রায় আচ্ছন্ন।” এটা যদি রোগের লক্ষণ হয়, তবে তার অন্যতম কারণ খুঁজে পাওয়া গেল আর এক প্রবীণ অধ্যাপকের কথায়। তাঁর মতে, এ দেশে উচ্চশিক্ষার অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
শনিবার ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের দু’টি পৃথক আলোচনাচক্রে শোনা গিয়েছে এমনই সব আক্ষেপের কথা। প্রথম জন চেন্নাইয়ের ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক জি রাজশেখরন এবং দ্বিতীয় জন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য দীপক পেন্টাল।
এ দিন ‘মেগা সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক আলোচনায় দেশ-বিদেশের বড় বড় বিজ্ঞানীরা ভারতের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান যাত্রার পথে নতুন নতুন মাইলফলকের কথা শোনান। কিন্তু তারই মাঝে তাল কাটে রাজশেখরনের মন্তব্যে। তিনি বলেন, “বিজ্ঞানে একের পর এক বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। অথচ সেগুলিতে কাজ করার জন্য যথেষ্ট মেধাবী গবেষক মিলছে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঘুমোচ্ছে।” ওই বিজ্ঞানী এখন যে কাজে যুক্ত, তাতে দরকার কয়েকশো দক্ষ তরুণ গবেষক। তিনি ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীরা তালিম দিতে শুরু করেছেন তরুণ বিজ্ঞানীদের। রাজশেখরনের মতে, এই তালিমের প্রয়োজন হত না, যদি বিশ্বদ্যালয়গুলি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেধাবী গবেষক বেরিয়ে আসত।
আলোচনাচক্রের শেষে অবশ্য রাজশেখরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌল বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা অরূপ রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে এখন উঁচু মানের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। তা ছাড়া, গবেষণায় উৎসাহ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে নানা রকম প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে।” রাজশেখরনের পাল্টা বক্তব্য, “অরূপবাবুর দাবি সত্যি হলে খুশি হতাম। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন্য।”
রাজশেখরনের বক্তব্য উড়িয়ে দেননি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচাযর্র্ শৌভিক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “রাজশেখরনের কথা অনেকাংশে সত্যি। তবে এ বছর যাদবপুরের সমাবর্তনে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনশোরও বেশি পিএইচ ডি ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। আরও বেশি কেন্দ্রীয় অনুদান পেলে সংখ্যাটা বাড়বে।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস কিন্তু পুরোপুরি ভিন্নমত। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো গড়তে রাষ্ট্র কতটা সাহায্য করে, সেটা আগে দেখা হোক। তা না করে এমন সব সমালোচনার কোনও মানে হয় না। গবেষণা সংস্থাগুলির জন্য যতটা অনুদান দেওয়া হয়, রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় তার অর্ধেকও পায় না।”
একই বক্তব্য হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সৈয়দ হাসনাইনের। তিনিও বলেন, “গোটা দেশে উচ্চশিক্ষায় যুক্ত রয়েছেন, এমন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৫০ শতাংশ পড়েন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ পড়াশোনা করেন রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। আর ৬ শতাংশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তা সত্ত্বেও ইউজিসি-র অনুদানের ৮০ শতাংশ পায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি!”
বিজ্ঞান কংগ্রেসে এ দিনই ‘ভারতের ভবিষ্যৎ রূপায়ণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা’ শীর্ষক আর একটি আলোচনাচক্রে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য দীপক পেন্টাল সেই বহুচর্চিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ তোলেন, যাকে অনেকেই এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করেন। পেন্টাল অবশ্য শিক্ষক সংগঠনগুলির অতিসক্রিয়তাকেও অনেকাংশে দায়ী করেছেন। অনেকের মতে, এই অতিসক্রিয়তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তারই ফসল। এই ব্যাপারে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র লাখোটিয়ার সংযোজন, উপাচার্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ সব ব্যাপারেই অস্বচ্ছতা থাকে।
এ রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই প্রবল। প্রায় তিন দশকের বাম আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে রাজ্য সিপিএমের সদর দফতর আলিমুদ্দিন থেকে। উপাচার্য, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগের বেলায় বহু ক্ষেত্রেই যোগ্যতার তুলনায় রাজনৈতিক আনুগত্যই বিবেচিত হয়েছে বলে শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই বারবার অভিযোগ করেছেন। আবার রাজ্যে পালাবদলের পরেও সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি বলেও অনেকের মত।
পেন্টাল অবশ্য বলেন, “এ দেশে প্রচুর কমিটি হয়, সেগুলি অনেক ভাল ভাল সুপারিশ করে। কিন্তু তা কার্যকর করার উদ্যোগ দেখা যায় না।” |