|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ২ |
বিবেকানন্দ বনাম রবীন্দ্রনাথ |
সত্যি কখনও দ্বন্দ্ব ঘটেছিল? উপলক্ষ কি নিবেদিতা? দেখা যাবে ‘শঙ্খমালা’র প্রযোজনায়।
লিখছেন বিপ্লবকুমার ঘোষ। |
যৌবনে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ওঠা ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব। ১৮৮৭ সালে নরেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সঙ্গীত কল্পতরু’। সেখানে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ১২টি গান অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গটি এল কারণ ১৮৯৯ সালের ২৮ জানুয়ারি শনিবারের এক বিকেলে বসেছিল চা-পানের আসর। নিবেদিতা ঠিক করেছিলেন তাঁর বাগবাজারের বাড়িতে তিনি চা-পানের আমন্ত্রণ জানাবেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু এবং বিবেকানন্দকে। এর আগে বহু বার নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে। এমনকী রবীন্দ্রনাথের কাছে বসে গানও শিখেছেন তিনি। (ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম আকর্ষণীয় যুবক কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঙ্গে রাজনারায়ণ বসুর কন্যা শ্রীমতী লীলার বিয়ে উপলক্ষে ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘যে প্রেমের পথ গেছে অমৃত সদনে, সে প্রেম দেখায়ে দাও পথিক দু’জনে’ গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে বসে শিখেছিলেন নরেন্দ্রনাথ।)
সেই চা-পানের আসরেই বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের কোনও কথাই হল না। দু’জন যে দু’জনকে চিনতেন সে কথাও প্রকাশ করলেন না কেউই। চা-পানের আসরে নিবেদিতার অনুরোধে গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে, শূন্য ঘাটে একলা আমি, পার করে লও খেয়ার নেয়ে’। কেন দু’জন একে অপরকে উপেক্ষা করলেন? নিবেদিতার উদ্যোগ সত্ত্বেও বিবেকানন্দ ও ঠাকুরবাড়ির মধ্যে সম্পর্কের শীতল বরফ গলেনি। বরং আরও কঠোর হাতে নিবেদিতার রাশ টেনে ধরেছেন বিবেকানন্দ। একটি সংলাপে বিবেকানন্দ বলছেন, ‘নিবেদিতা, তুমি যত দিন ওই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করবে তত দিন আমাকে বারবার সাবধান করে যেতে হবে। মনে রেখো, ওই পরিবার বাংলাদেশকে শৃঙ্গার রসের বন্যায় বিষাক্ত করছে।’ নিবেদিতা বললেন, ‘আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’ তখনই বিবেকানন্দ ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা শোনালেন। বললেন, ‘তোমার কি মনে হয় না এই কবিতা পুরোপুরি শৃঙ্গার রসে পরিপূর্ণ?’ বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী। জন্ম-মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে ভূমার অনন্ত রূপ অন্বেষণই তাঁর জীবনের ব্রত। রবীন্দ্র সাহিত্যের ক্রম বিবর্তন সম্পর্কে মনোযোগী থাকার মত অবসর বা ইচ্ছা কোনওটাই তখন বিবেকানন্দের ছিল না। কারণ যখন তিনি নিবেদিতাকে ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি শোনাচ্ছেন তখন রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেছেন ‘চিত্রা’র কবিতা।
‘...ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনি, স্কন্ধে যত চাপে ভার।’
এ কথা তো বিবেকানন্দেরও কথা।
আবার অন্য ঘটনাও বলা যায়। একবার রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর মেয়ের ইংরেজি শিক্ষার ভার নেওয়ার জন্য। কিন্তু নিবেদিতা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আপনার মেয়েকে বিলিতি খুকি বানানোর কাজটা কখনই করতে পারব না। |
|
বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ঠিক কী রকম ছিল সেই সম্পর্কে নানা তথ্য উঠে এসেছে শঙ্খমালার একটি নতুন প্রযোজনা ‘বীরেশ্বর’-এ। যেমন, বিবেকানন্দের নির্দেশে নিবেদিতা যখন মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে একটি বিদ্যালয় গড়তে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর একটি অংশ নিবেদিতাকে স্কুলের জন্য দিতে চেয়েছিলেন। নিবেদিতা তখনও তাতে সম্মতি জানাতে পারেননি। অনুমান করা যায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে তাঁর ‘রাজা’র (এই নামেই তিনি মাঝে-মধ্যে স্বামীজিকে সম্বোধন করতেন) সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করতে পারলেন না।
প্রযোজনার একটি পর্বে দেখানো হয়েছে, নিবেদিতার কাছে বিবেকানন্দ নিজেকে শিব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৮৯৮-এর ১১ মে নিবেদিতাকে নিয়ে বিবেকানন্দ আলমোড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেখানে সূর্যের অসামান্য রঙ-বদল দেখে নিবেদিতা অভিভূত। তখন বিবেকানন্দ বলছেন, ‘ঐ যে বিশাল, ঐ যে ধ্যান-গম্ভীর, উদাসী শিখর, শিবও তেমন বিশাল সুন্দর। আর ঐ সূর্যের আলো? সেটা হচ্ছে উমা। দু’জনের সংযোগে অপার রহস্য আর অপরিসীম সৌন্দর্য সৃষ্টি হচ্ছে। নিবেদিতা, আধ্যাত্মিক মিলন-ই কাম্য।’
অষ্টাদশ দৃশ্যে প্যারিস থেকে নিবেদিতাকে লেখা একটি চিঠির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘......নিবেদিতা, তুমি যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ তাদের সম্বন্ধে আমার কোনও ঈর্ষা নেই। আমার শুধু ভয় তোমার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মেশার ফলে তোমার মন যে দিকে ঝুঁকবে, তুমি অন্যের ভিতর জোর করে সেই ভাব দেবার চেষ্টা করবে। আমি এই কারণেই সেই বিশেষ প্রভাব থেকে তোমাকে দূরে রাখতে চেয়েছি.......।’
প্রযোজনাটি দেখলে একটি প্রশ্ন জাগবেই। বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ একই সময়ে যখন দেশের জাগরণ নিয়ে ভাবছেন, তখন কেন দু’জনের সম্পর্ক এত খারাপ হল? তার কারণ কি নিবেদিতা? পরিচালকের কথায়, “জানি না।”
এমনই নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সুমন্ত্র সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘বীরেশ্বর’ (বাসব দাশগুপ্তের রচনা) শীর্ষক একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে। সুমন্ত্রের দাবি, “তর্ক-বিতর্কেরও সমূহ সম্ভাবনা। এই প্রযোজনার অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে নিবেদিতাকে কেন্দ্র করে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের শীতলতার কারণগুলির অনুসন্ধান।”
প্রযোজনায় সঙ্গীতের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। শ্রীকান্ত আচার্য রয়েছেন সঙ্গীত পরিচালনায়। কী বলছেন তিনি? “আমি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে বড় কারণ আগে এরকম কাজ কখনও করিনি। একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সত্যি কথা বলতে কি একটা চ্যালেঞ্জও বলতে পারেন। সঙ্গীত এখানে বড় ভূমিকা নিয়েছে প্রযোজনার গতি বাড়াতে। দেখা যাক কি হয়।” দৃশ্য-ভাবনা-পরিকল্পনায় রয়েছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ধারণা, “মানুষ বিবেকানন্দ, যাঁকে অন্য ভাবে দেখা। আমি বাচিক অভিনয়ের মূল ধারাকে রেখে একটা সামগ্রিক প্রযোজনা তুলে ধরতে চেয়েছি। প্রথাগত পুরনো ধারা না রেখে আধুনিক পারফর্মিং আর্টকেই গুরুত্ব দিয়েছি।”
উল্লেখ্য, সম্ভবত এই প্রথম কলকাতার মঞ্চে কোনও বাচিক সংস্থার প্রযোজনায় এই ধরনের প্রযোজনা দেখা যাবে।
স্টার থিয়েটারে, উনিশে জানুয়ারি, সন্ধে সাড়ে ছ’টায়। |
|
|
|
|
|