ব্যাগ গুছিয়ে...
মুকুটশোভিত অপরূপা
প্রকৃতি এখানে শিশুর মতোই কথা বলে আপন খেয়ালে। অলক্ষে চলে জল-পাহাড়ের হাত ধরাধরি। মেঘের লুকোচুরি পাহাড়ের সঙ্গে। এক দিকে বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা দিগন্ত আর অন্য দিকে পাহাড়-টিলার আড়ালে সূর্য বিসর্জনে যায় দিনের শেষে। লকগেট থেকে জল ছাড়ার অনাবিল সৌন্দর্য। ঘরের কাছেই মুকুটমণিপুর ঠিক এমনই।
বাঁকুড়া থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছু দূর পার করলে টিলাময় দেশ। বড় রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে ঘুরে কিছুটা গেলেই গাছপালা ঘেরা নির্জনতা। পিচঢাকা রাস্তায় চড়াই-উৎরাই ডিঙিয়ে কংসাবতী জলাধার। ভরা বর্ষায় জলাধারের জল ছাড়া দেখতে উৎসাহীদের ভিড়। লকগেটের ওপর সেতুতে জলের ঝাপটে জামাকাপড় ভিজে একাকার। জলের প্রবল গর্জনে কান পাতা দায়।
ক্যামেরার লেন্সে জলের বিন্দু। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে ওয়াইপারের ব্যস্ততা। জলের বিন্দু চশমার কাচেও। হঠাৎ এক ঝলক রোদ্দুরের দেখা মিলতেই লকগেটের ওপর রামধনুর খেলা। পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উঠছে জল। উথালপাথাল। শুধুই উথালপাথাল। ঝোপজঙ্গল এড়িয়ে পাহাড় বেয়ে উৎসাহীদের ওঠানামা। ভীমকায় জলরাশি আরও কাছ থেকে দেখার আনন্দ। সবুজের নানান শেড পাহাড়জুড়ে। জঙ্গলে ঢাকা পান্না-সবুজ পাহাড়ে রং-বেরঙের প্রজাপতি পাখনা মেলে নিজস্ব রীতিতে।
জলাধার থেকে বের হওয়া নদীটা একটু দূরে এঁকেবেঁকে পাহাড়ের খাঁজে হারিয়ে যায়। ছোটনাগপুর জুড়ে যখন আকাশ ভেঙে পড়ে, কুমারী আর কংসাবতীর শরীর স্ফীত হয় দ্রুত। বছরভর ঘুমিয়ে থাকা নদীগুলোয় জল বাড়ে হু হু করে। মাঠঘাট ধুয়ে জল জমে মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধারে।
সামান্য এগোলেই বাঁধ। ঘুমিয়ে রয়েছে জলরাশি। নিস্তরঙ্গ জলে ইতিউতি নৌকোর আনাগোনা। পারাপারে ব্যস্ত স্থানীয়রা। এ পারে বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর, ও পারে পুরুলিয়া। দূরে পাহাড়-টিলার সারি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। আকাশ-পৃথিবী আর জল মিলেমিশে একাকার। আপন মনেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে হাতের ক্যামেরাটা।
বছরের যে কোনও সময়েই মুকুটমণিপুর চিত্রগ্রাহকদের স্বর্গরাজ্য। সুবিশাল জলরাজ্যে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকা পাহাড়-টিলার মাঝে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যায় সূর্যটা। সকলের অলক্ষে কখন যেন ডুবে যায় টুপ করে।
জলাধারের আনাচে-কানাচে ঘুরতে একমাত্র ভরসা নৌকো। জলাধারের অন্য দিকে নৌকো থেকে নেমে খানিকক্ষণের জন্য বনের মাঝে হারিয়ে যেতে মন্দ লাগবে না। নির্জন বনপথে মাঝেমধ্যে সাইকেল আরোহী স্থানীয়দের আনাগোনা। পায়ে চলা রাস্তা ঢাকা পড়েছে বুনো ফুলের বিছানায়। রঙিন কার্পেট যেন।
মন উদাস করা নির্জনতা ভেঙে হঠাৎই উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। জলাধারে কাচের মতো স্বচ্ছ জল। সামান্য পা ডুবিয়ে বসে থাকা। নৌকাভ্রমণের মাঝেই ও পারে নেমে ঘুরে দেখা যেতে পারে ‘ডিয়ার পার্ক’। প্রায় ৩০ বছর আগে অল্প কয়েকটি হরিণ দিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্প। এখন হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। দূরে দেখা যায় জলে ভেসে থাকা পাথুরে টিলার সারি। সেই সঙ্গে মৃদুমন্দ হাওয়ায় শোনা যায় জলে কুলুকুলু রব। অজান্তে সময় বয়ে যাবে বহতা নদীর মতোই। মাঝির ডাকে সম্বিত ফিরবে। আবার ফিরে চলা।
বাঁধ ধরে হাঁটা লাগালে পড়বে পরেশনাথের পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় পরেশনাথের মন্দির। খোলা মন্দির। সামান্য বেদির ওপর শিবলিঙ্গ। এক পাশে পাথরের ষাঁড়। নিখুঁত ভাস্কর্য। অনামী শিল্পীর অনবদ্য সৃষ্টি। জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি পড়ে রয়েছে মাটিতে। এই অঞ্চলে বেশ কিছু জৈন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছিল জলাধার তৈরির সময়। বেশিরভাগই জলের নীচে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। কিছু তুলে রাখা হয়েছিল পাহাড়ের মাথায়। সেগুলিই টিকে রয়েছে কোনওমতে।
মুকুটমণিপুর থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে অম্বিকানগর। ছোট্ট জনপদ। দেবী অম্বিকার নামেই গ্রামের নাম। মন্দিরে পূজিত দেবী। দুর্গাপুজোয় মহা ধুমধাম করে পুজো হয় চার দিন ধরেই। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকেই আসেন সে সময়। আসলে জৈন দেবী। পরে হিন্দুদের দেবীতে পরিণত হয়েছেন।
স্থানীয়রা বলেন, রাজস্থানের এক রাজা শিকার করতে গিয়ে এই অঞ্চলে আসেন বহু বছর আগে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর রানিও। এক রাতে স্বপ্নে দেবী অম্বিকা রাজাকে দেখা দিয়ে বলেন, এখানেই তাঁর পুজো করতে হবে। রাজা সেই নির্দেশ পালন করেন। স্থাপিত হয় মন্দির। রানির নাম ছিল মুকুটমণি। রানির নামেই পাশের জনপদটির নাম রাখা হয়। গ্রামের মধ্যে রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ এখনও রয়েছে।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে সকাল ছ’টার রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস অথবা সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশের শালিমার
আরণ্যক এক্সপ্রেস ধরে বাঁকুড়া। বাঁকুড়া থেকে ভাড়া গাড়িতে মুকুটমণিপুর ৫৫ কিলোমিটার।
কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে দুর্গাপুর, বাঁকুড়া হয়েও যাওয়া যায়। সময় লাগে ঘণ্টাছয়েক।
হোটেলে আগাম বলে রাখলে প্রয়োজনে বাঁকুড়া থেকে পিক আপ পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন

বন উন্নয়ন নিগম, সেচ দফতরের বাংলো ছাড়াও কিছু বেসরকারি
রিসর্ট ও হোটেল রয়েছে। আগে থেকে বুক করে যাওয়া ভাল।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.