ভারত-বিরোধিতার প্রচলিত ছকের বাহিরে গিয়া পাকিস্তান কি অবশেষে দেশের ভিতরেই আপন নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশকারী শক্তিগুলির ঠিকানা খুঁজিতেছে? অন্তত পাক সেনাবাহিনীর নিজস্ব তত্ত্ববিশ্ব ‘গ্রিন বুক’-এ তাহারই ইঙ্গিত। সেনা-কর্তৃপক্ষ এই প্রথম জেহাদি সন্ত্রাসবাদ বিশেষত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সক্রিয় জঙ্গি তালিবানি তৎপরতাকে দেশের প্রধান শত্রু শনাক্ত করিয়াছেন। এবং ভারত বা পূর্ব সীমান্ত হইতে আসন্ন কোনও বিপদের কথা উল্লেখও করা হয় নাই। এই নজিরবিহীন মূল্যায়ন স্পষ্টতই পাক সেনাবাহিনীর রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানে একটি মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করে।
ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করিতে উদ্যত জন্মলগ্ন হইতেই অর্থাৎ গত ৬৫ বছর ধরিয়াই পাকিস্তানি জনসাধারণকে এই তত্ত্ব গলাধঃকরণ করানো হইয়াছে। প্রশিক্ষণের পুরোভাগে থাকিয়াছেন পাক জেনারেলরা, যাঁহারা জাতীয় জীবন ও সমাজে নিজেদের গুরুত্ব, মূল্য ও মর্যাদা বাড়াইতে ভারতবিরোধী যুদ্ধের জন্য পাক সেনাবাহিনীকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী ও সমরাস্ত্রসজ্জিত করার উপর জোর দিয়া গিয়াছেন। কার্গিল সংঘর্ষ বাদ দিলে চার দশকে ভারতের সহিত কোনও লড়াই বাধে নাই। অথচ আফগান মুজাহিদিন, তালিবান, আল-কায়দা, আফগান ও পাক তালিবান ইত্যাদি শক্তি জেহাদি বিভিন্ন গোষ্ঠীর (যেমন হক্কানি গোষ্ঠী) সহিত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সঙ্কটাপন্ন করিয়া তুলিয়াছে। জেহাদি জঙ্গিরা এখন ইচ্ছা করিলেই পাকিস্তানের যে কোনও স্থানে, যেমন করাচির নৌঘাঁটি, ইসলামাবাদের বিমানঘাঁটি ইত্যাদি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে যথেচ্ছ আঘাত করিতে পারে, করিতেছেও। জঙ্গি তৎপরতার মোকাবিলায় রাষ্ট্র ও তাহার নিরাপত্তা সংস্থাগুলির অসহায় আত্মসমর্পণ সম্ভবত জনসাধারণের মনেও প্রশ্ন তুলিয়াছে, এ সবের পিছনে তো ভারত নাই। নিজেদের এত কালের দেওয়া অপযুক্তির অসারতা উপলব্ধি করিয়াই সম্ভবত পাক জেনারেলরা তাঁহাদের বিপদ-তালিকা হইতে ভারতকে বাদ রাখিয়াছেন।
পাকিস্তানে নির্বাচনও আসন্ন হইয়া উঠিতেছে। এই নির্বাচনে পিপল্স পার্টি, মুসলিম লিগ কিংবা জামাতপন্থীরাই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, যদিও প্রকাশ্যে তাঁহারাই দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ। সেনাবাহিনী স্পষ্টতই সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একটি নির্দিষ্ট বার্তা দিতে চাহিতেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত ঘটাইতে জেহাদিদের অপচেষ্টা যে বরদাস্ত করা হইবে না, সেই বার্তাটি স্পষ্ট। একই ভাবে জেহাদিদের সহায়তা লইয়া কোনও রাজনৈতিক দল জনাদেশের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ বা বিকৃত করার চেষ্টা করিলে তাহাও যে বাধাপ্রাপ্ত হইবে, সেনাবাহিনী সেটাও স্পষ্ট করিতে চায়। অতীতে এ ভাবে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী শক্তির তরফে জেহাদিদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন লইয়া ক্ষমতাসীন হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। তবে সে সময় সেনাবাহিনী, বিশেষত আইএসআই-ও সেই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শামিল ছিল। সেনা-কর্তারা হয়তো ঠেকিয়া শিখিয়াছেন যে, জেহাদিদের প্ররোচনা শেষাবধি ব্যুমেরাং হইয়া যায়। |