মার্কিন সরকার অল্পের জন্য রক্ষা পাইয়াছে। এবং অল্পকালের জন্য। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট এবং রিপাবলিকান-প্রধান প্রতিনিধিসভার মধ্যে দ্বৈরথ চলিতেছিল সরকারি আয়ব্যয়ের নীতি লইয়া। বাজেট ঘাটতি কমানো জরুরি, সেই বিষয়ে দুই তরফই একমত। কী ভাবে কমানো হইবে, তর্ক তাহা লইয়াই। প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রধানত মধ্যবিত্ত এবং সম্পন্ন নাগরিকদের কর বাড়াইয়া উদ্দেশ্য সাধন করিতে চাহেন। রিপাবলিকানদের দাবি, সরকারি ব্যয়সঙ্কোচ করা দরকার, এমনকী সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন খাতেও। ডেমোক্র্যাটদের তাহাতে ঘোর আপত্তি, ঠিক যেমন রিপাবলিকানদের আপত্তি করবৃদ্ধির প্রস্তাবে জর্জ ডব্লিউ বুশের ‘রিড মাই লিপস, নো নিউ ট্যাক্সেস’ প্রতিশ্রুতি তিনি নিজে রক্ষা করিতে পারেন নাই, কিন্তু কম কর এবং কম ভর্তুকির ভিত্তিতে ‘ছোট সরকার, সুখী সমাজ’-এর মূল নীতি রিপাবলিকানদের বীজমন্ত্র হইয়াই রহিয়াছে, মিট রোমনিও তাঁহার ব্যর্থ প্রচারে তাহাই জপ করিয়াছেন।
এই মতানৈক্য মৌলিক এবং দুরপনেয়। অথচ মার্কিন নিয়মে প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের দুই সভার মধ্যে বোঝাপড়া না থাকিলে বাজেট অনুমোদিত হয় না, সরকার সঙ্কটে পড়ে। বিল ক্লিন্টনের আমলে এমনই এক সঙ্কটে কয়েক দিনের জন্য সম্পূর্ণ অচলাবস্থা দেখা দিয়াছিল। ২০১২ সালের অন্তিম লগ্নে যে বিপদ দেখা দিয়াছিল, তাহার পরিণাম আরও সুদূরপ্রসারী হইত। বাজেট ঘাটতি কী ভাবে কমানো হইবে, সেই বিষয়ে দুই তরফের বোঝাপড়া না হইলে নূতন বছরের শুরু হইতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনেক নাগরিকের করের বোঝা বাড়িয়া যাইত এবং অনেক ধরনের সরকারি ব্যয় ছাঁটাই হইত। তাহাতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান, দুই শিবিরের মুখেই চুনকালি পড়িত। কিন্তু সেখানে সঙ্কটের শুরু। বাজেট সমস্যার সমাধান না হইলে মার্কিন অর্থনীতির উপর দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যাপক প্রভাব পড়িত। সেই অর্থনীতি এমনিতেই বিপন্ন, নূতন মন্দার মেঘ জমিলে দেশের পক্ষে তাহার পরিণাম হইত বিপজ্জনক। এবং দেশের নাম যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুতরাং দুনিয়ার পক্ষেও। প্রায় শেষ মুহূর্তে দুই পক্ষের রফা হইয়াছে, আপাতত উচ্চবিত্তের উপর কিছুটা কর বাড়াইয়া বাজেট ঘাটতি সামান্য কমাইবার প্রস্তাবে রিপাবলিকান সমর্থন আদায় করিতে পারিয়াছেন বারাক ওবামা। চরম বিপর্যয় হইতে অল্পের জন্য রক্ষা মিলিয়াছে।
কিন্তু অল্পকালের জন্য। প্রথমত, সামাজিক ব্যয় কমাইবার প্রস্তাবটি দুই মাসের জন্য মুলতুবি রাখিতে রিপাবলিকানরা সম্মত হইয়াছেন। দুই মাস ক্ষণকালমাত্র। দ্বিতীয়ত, দুই মাস পরে সেই ব্যয়সঙ্কোচ যদি ঘটে, তাহা হইলেও বর্তমান করবৃদ্ধির সহিত তাহার হিসাব যোগ করিয়া যেটুকু ঘাটতি কমিবে, অতিকায় মার্কিন বাজেটের বিপুল ঘাটতির তুলনায় তাহা গোষ্পদমাত্র। ওবামা জানেন, বাজেট ঘাটতি কমাইতে না পারিলে সরকার চালানো দুঃসাধ্য। তাঁহার দাবি, হয় কর আরও বাড়ানো হোক, নয়তো সরকারি ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হোক। রিপাবলিকানরা দুইয়ের কোনওটিই চাহেন না। তাঁহাদের বক্তব্য, সরকার সামাজিক ব্যয় কমাক। আগামী দুই মাস এই মৌলিক মতভেদ কমাইয়া নূতন আপসের চেষ্টা চলিবে। দর কষাকষিতে ওবামার সুবিধা বেশি। এক, তিনি ‘সাধারণ মানুষ’-এর ভোটে সদ্য দ্বিতীয় বার জয়ী। দুই, তাঁহার ভোটদাতাদের অধিকাংশ বস্তুত, মার্কিন আমজনতার বিরাট অংশ সরকারি ব্যয়সঙ্কোচের বিরোধী, বিশেষত এই মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে। কিন্তু ওবামার এই সুবিধা রাজনৈতিক। অর্থনীতির দাবি: ঘাটতি এবং ঋণে লাগাম টানা। ৯/১১-উত্তর কালে, অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে, মার্কিন (কেন্দ্রীয়) সরকারের ঋণ বাড়িয়া তিনগুণ হইয়াছে। ইহা, আক্ষরিক অর্থেই, দুর্বহ। বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক গুরুত্ব ক্রমশ কমিতেছে। ফলে অন্য দেশের উদ্বৃত্ত ঋণ হিসাবে পাইবার সুযোগও ভবিষ্যতে কমিবে। অর্থাৎ, আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয়বরাদ্দ নির্ধারণের নীতি মার্কিন সরকারকেও আজ না হোক কাল অনুসরণ করিতেই হইবে। অর্থনীতির এক ঘাটে জল না খাইয়া শেষ অবধি ওয়াশিংটন এবং দিল্লির গতি নাই। |