|
|
|
|
জেরার বাউন্সার এড়াতে দিল্লি সফরে নেই দাউদের বেয়াই
গৌতম ভট্টাচার্য • নয়াদিল্লি |
ক্রিকেটজীবনে বলা হত, যত বেশি চাপ, তত বেশি ভাল খেলবেন! সর্বাত্মক চাপের মুখে সত্যিই সব সময় নিজের ক্রিকেটে বাড়তি কাঠিন্য আমদানি করেছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ! লিলি থেকে হোল্ডিং মারাত্মক সব ফাস্ট বোলারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আজকের চাপ অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। ব্যাট দিয়ে, নিজের খ্যাতি দিয়ে সেই লাভাস্রোতকে মোকাবিলা করার উপায় নেই। কী ভাবে লুকোবেন তিনি দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিগত সম্পর্ক? বেগতিক দেখে রণে ভঙ্গ দিলেন মিয়াঁদাদ। বাতিল করলেন বৈধ ভারতীয় ভিসা হাতে থেকেও তাঁর আড়াই দিনের ভারত সফর। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তাঁর ভিসা মঞ্জুর করে বিরোধীদের গভীর আক্রমণের মুখে পড়া ভারত সরকারও।
লাহৌরে যোগাযোগ করে জানা গেল, পাকিস্তান বোর্ডের প্রধান জাকা আশরফ ভারত থেকে ফোনে মিয়াঁদাদকে সফর বাতিলের নির্দেশ দেন। চাকরিসূত্রে মিয়াঁদাদ এখন বোর্ড প্রধানের অধীন। পাক ক্রিকেটমহল মনে করছে, দাউদের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তাকে কেন্দ্র করে ভারতে ঠিক এই মুহূর্তে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি রয়েছে, তাতে মিয়াঁদাদ হাজির হলে আগুনে ঘি পড়বে। বিশাল বিতর্ক তৈরি হবে। কোটলায় ব্যারাকিংয়ের মুখেও পড়তে পারে মিসবা-র পাকিস্তান। টিম এত ভাল খেলছে। সেখান থেকে ফোকাস নড়ে যেতে পারে।
গত দেড় বছর পাক টিমের ম্যানেজার রয়েছেন নাভিদ আক্রম চিমা। চিমা ওকোরির মতোই গাঁট্টাগোট্টা আর টাফ। দলের অভিভাবকসদৃশ চিমা ইডেন জয়ের পর ছেলেদের বলেছেন, “ফুর্তিটুর্তি যা হবে দেশে ফিরে। এখন ইন্ডিয়াকে ৩-০ মারায় সবাই মন দাও।” আজ পর্যন্ত কোনও পাকিস্তান টিম ভারতে এসে এমন চুরমার করে জিততে পারেনি। পাক বোর্ডের আশঙ্কা, মিয়াঁদাদ শনিবার রাতে এসে পড়লে এমন ধুন্ধুমার পড়ে যেত যে ‘মিশন ৩-০’ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত প্রচণ্ড ভাবে।
তাই নির্ধারিত সূচি মেনেই প্রাক্তন পাক পেসার জাকির খান এবং পাক বোর্ডের সিইও-ই শুধু আগামী কাল দিল্লির বিমানে উঠছেন। দাউদের বেয়াইকে দেশে রেখে। যিনি ঘটনাচক্রে প্রাক্তন ক্রিকেটতারকা! |
মিয়াঁদাদের বেয়াই। এঁর জন্যই পাক প্রাক্তনের ভারতে আসা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা। |
শুক্রবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত আনন্দবাজার থেকে করাচিতে মিয়াঁদাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও লাভ হল না। কখনও মোবাইল বাজলেও তিনি ধরেননি। কখনও সুইচ অফ করে দিয়েছেন। করাচি থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠরা অবশ্য জানালেন, সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত একান্তই মিয়াঁদাদের ব্যক্তিগত। বোর্ড নির্দেশ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে মিয়াঁদাদ নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, ভারতে গিয়ে কাজ নেই। দাউদ নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা দফতরের অনন্ত জিজ্ঞাসাবাদের সম্ভাবনার মুখে তিনি পড়তে চাননি। নিজস্ব নিরাপত্তারও নাকি অভাব বোধ করেছেন।
দাউদ-কন্যা মহরুখের সঙ্গে তাঁর পুত্র জুনেইদের বিয়ে হয় বছর চারেক আগে। দুই পরিবার যে সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছে, এমন নয়। এঁদের আলাপ ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে।
দাউদ আর মিয়াঁদাদের খাতির অবশ্য শারজা ক্রিকেটের সময় থেকে। আত্মীয়তার ছোঁয়ায় এখন তা এমনই গাঢ় যে, করাচিতে নাকি নিয়মিত এঁদের দেখাসাক্ষাৎ। শোনা যায়, করাচির অত্যন্ত সুরক্ষিত এলাকা ডিফেন্স কলোনিতে ততোধিক সুরক্ষিত দাউদের বাড়ি। মিয়াঁদাদ থাকেন ক্লিফটনে। এক কিলোমিটারের মধ্যে।
পাক বোর্ডে আট লক্ষ টাকা মাস মাইনের পদে আসীন মিয়াঁদাদ কিন্তু মোটেও জনপ্রিয় নন। তার কারণ, প্রভূত ঐশ্বর্য দিয়ে তিনি ও তাঁর পরিবার বোর্ডে ক্রমশ ক্ষমতা হস্তগত করে ফেলছেন। পাকিস্তান শিগগিরই আইপিএলের ধাঁচে শুরু করছে পিপিএল। আটটা টিম খেলবে। তার মধ্যে চারটে টিমের ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনে নিয়েছেন মিয়াঁদাদ-পুত্র জুনেইদ। এক জনের হাতে এতগুলো টিম থাকলে তাতে আন্তর্জাতিক বেটিং সিন্ডিকেটের রমরমা বাড়বে বলেই বোর্ড সদস্যদের আশঙ্কা।
মিয়াঁদাদ-ঘনিষ্ঠরা অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের সবচেয়ে আধুনিক শহর তথা নিজের বসতভিটেয় মিয়াঁদাদ দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছেন দাউদ করাচিতে এসেছেন বলেই! নইলে নব্বই দশকে উত্তাল এমকিউএম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন দেখে শঙ্কিত মিয়াঁদাদ তো লাহৌর চলে গিয়েছিলেন। ইমরানের শহরে বাড়ি করে বছর পনেরো ছিলেন। হঠাৎ ফেরত আসেন করাচিতে।
পাক সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, মার্কিন বাহিনীর হাতে বিন লাদেন মারা পড়ার পরেই দাউদ দেশ ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এখন তিনি বহাল তবিয়তে করাচিতে। মাসখানেক আগে করাচি-লাহৌর ফ্লাইটে মিয়াঁদাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আটাত্তরের ভারত সফরে আসা তাঁরই এক সহ-খেলোয়াড়ের। ইনি স্পিন বল করতেন। কিন্তু লাহৌর বিমানবন্দরে যে তাঁর জন্য ‘এতটা স্পিন’ অপেক্ষা করে আছে ভাবতেই পারেননি। মিয়াঁদাদ নিজেই নাকি আলাপ করিয়ে দেন তাঁর সঙ্গীর সাথে। “আমার বেয়াই দাউদ।” বিস্ময়াবিষ্ট ক্রিকেটারটি পরে বন্ধুমহলে বলেছেন, “এমন কারও সঙ্গে কখনও হ্যান্ডশেক করিনি যার মুখটাই ভাল করে দেখতে পেলাম না। সে ঘাড় না ঘুরিয়ে হাত মেলাল বলে।”
ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যায় পড়া ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মিয়াঁদাদ নিয়ে গিয়েছিলেন লাহৌরের বিখ্যাত এক পিরের কাছে। বিশাল লাইন সেখানে। পাশে ফাঁকা একটা ঘরে টিভি চলছে। সেখানে কেউ বসে চ্যানেল সার্ফ করছে। বন্ধুকে দেখিয়ে মিয়াঁদাদরা যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখনও লোকটির চ্যানেল ঘোরানো অব্যাহত। তাঁর দিকে একটু হেসে মিয়াঁদাদ বন্ধু-সহ বেরিয়ে গেলেন। বন্ধু জানতে চাইলেন, “এ কি পিরবাবার অফিস দেখাশোনা করে?” মিয়াঁদাদ হাসলেন, “আরে না না। ও আমার বেয়াই দাউদ ইব্রাহিম।” শুনে বন্ধুটি প্রায় বাক্রহিত। কারণ দাউদ কে এবং কী, গড়পড়তা পাক আওয়ামও জানে!
তাই পাক ক্রিকেটমহলে অনেকেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন, যেখানে প্রায় প্রকাশ্যেই মহাবিতর্কিত বেয়াইয়ের সঙ্গে তাঁর এত নৈকট্য, সেখানে ভারত সফরে আসতে রাজি হলেন কী করে মিয়াঁদাদ? জানা কথাই তো, যে তাঁকে ভারতীয় গোয়েন্দারা প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেবে! সিএবি সূত্রের খবর, ভারতীয় দূতাবাসে দু’টো শহরের জন্য ভিসা চেয়েছিলেন প্রাক্তন পাকিস্তানি অধিনায়ক। কলকাতা আর দিল্লি। সেই মতো ইডেন তৈরি ছিল মিয়াঁদাদকেও খোলা জিপে তুলবে বলে। কিন্তু সংশোধিত দ্বিতীয় লিস্টে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হয়। জানা যায় মিয়াঁদাদের কেবল দিল্লির ভিসা মঞ্জুর হয়েছে। কলকাতার নয়।
২০০৫-এ শেষ ভারত সফরে এসেছিলেন মিয়াঁদাদ। খাস পাকিস্তানেই অনেকের মনে হচ্ছে, জীবদ্দশায় আর ভারত ঢুকতে দেবে না তাঁকে। তিনি যে প্রাক্তন ক্রিকেটতারকার চেয়েও বেশি জ্বলজ্বল করছেন কুখ্যাত দাউদের সুখী বেয়াই হিসেবে! |
|
|
|
|
|