রিজের পাড়ায় আমিরুলের জন্য মিছিল
রিজওয়ানুর-মামলার জেরে বদলি হতে হয়েছিল কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে। এ বার আমিরুল-কাণ্ডে কড়েয়া থানার তিন পুলিশ কর্মীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতা পুলিশ-কর্তৃপক্ষ।
রিজের মৃত্যুর জন্য তাঁর পরিবার লালবাজারের অন্য চার অফিসারের সঙ্গে তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছিল। আমিরুলের পরিবারও সরাসরি অভিযোগ তুলেছে কড়েয়া থানার তিন পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে। তাঁদের মধ্যে দু’জন সাব-ইনস্পেক্টর (বিনোদ কুমার ও রঞ্জিত যাদব), এক জন কনস্টেবল (নাসিম খান)। তাঁদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা শুরু করেছে পুলিশ। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মামলা দায়ের করা হয়েছে কড়েয়া থানার অপরাধ দমন শাখার প্রাক্তন কনস্টেবল হারুন খানের বিরুদ্ধেও। কড়েয়া থানার সদ্যপ্রাক্তন এবং বর্তমান ওসি-র ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মাস খানেক আগে ওই থানার ওসি বদল হয়েছে। আগের ওসি-র আমলে আমিরুল-কাণ্ডের নানা ঘটনা ঘটেছে। আর, গত ৩ ডিসেম্বর আমিরুল থানার সামনে গায়ে আগুন দিতে যাচ্ছেন শুনেও বর্তমান ওসি কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ।
এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন দাবি করেন, “রিজওয়ানুরের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাম সরকারের হাত কেঁপে গিয়েছিল। আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। তদন্তে যা উঠে আসবে, সেই মতো সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রতিবাদের নাম আমিরুল। শুক্রবার তাঁর বাড়ি থেকে পার্ক
সার্কাস মোড় পর্যন্ত মোমবাতি মিছিলের পর। —নিজস্ব চিত্র
লালবাজারের কর্তাদেরও দাবি, অভিযোগ ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কড়েয়া থানার অভিযুক্ত দুই সাব-ইনস্পেক্টর এবং এক কনস্টেবলকে ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁদের থানার ডিউটি থেকে সরিয়ে দিয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। শাহজাদার সঙ্গে যোগসাজশ-সহ ওই তিন পুলিশ-কর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করছেন যুগ্ম কমিশনার (সংগঠন) ত্রিপুরারি। এ দিন সকালে ত্রিপুরারি কড়েয়া থানায় যান। তাঁর রিপোর্টে ওই তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হলেই তাঁদের সাসপেন্ড করা-সহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এতেই ক্ষোভ মিটছে না রিজ-আমিরুলের পাড়ায়। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, কড়েয়া থানার সামনে আমিরুল গায়ে আগুন দেওয়ার পরদিন (৪ ডিসেম্বর) পুলিশ গ্রেফতার করে ধর্ষণে অভিযুক্ত শাহাজাদা বক্সকে। তখনই কেন লালবাজার আমিরুলের দায়ের করা অভিযোগ (৩১ অক্টোবর) নিয়ে তদন্ত শুরু করল না? আমিরুলের বাবা আক্ষেপ করে বলেছেন, “অভিযোগ পাওয়ার পরেই পুলিশ শাহাজাদাকে গ্রেফতার করলে আমার ছেলেকে এ ভাবে মরতে হত না। ও গায়ে আগুন দেওয়ার পরেই অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলে আমার ছেলে শান্তি পেত।” স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজী মাসুম আখতারের বক্তব্য, “আমিরুলকে প্রকারান্তরে খুনই করা হয়েছে। পুলিশের কাছে অপমানিত হয়েই তো ছেলেটা আত্মঘাতী হল।”
আমিরুল কড়েয়া থানায় জমা দেওয়া তাঁর চিঠির প্রতিলিপি পাঠিয়েছিলেন ডিসি (দক্ষিণ-পূর্ব), যুগ্ম কমিশনার ক্রাইম, যুগ্ম কমিশনার সদর এবং পুলিশ কমিশনারকে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তারাও আমিরুলের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। সিবিআই তদন্তের দাবি তুলছেন তাঁরা। আমিরুলের বাড়িতে বসেই ওই তিন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবি জানান আমিরুলের আইনজীবী নৌসাদ হোসেন। তাঁর কথায়, “যে পুলিশ আমিরুলের অভিযোগ কানে তোলেনি, তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কী তদন্ত করবে? নিরপেক্ষতার স্বার্থেই সিবিআই তদন্ত চাই। সরকার রাজি না হলে হাইকোর্টে যাব।” শুক্রবার সকালে আমিরুলদের বাড়ি গিয়ে একই দাবি জানিয়ে এসেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। এ দিন কলকাতার পুলিশ কমিশনার আমিরুলের বাবা-মাকে কথা বলার জন্য লালবাজারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমিরুলের মা অসুস্থ থাকায় ওঁরা যেতে পারেননি।
রাফাত ইজহার
আমিরুলের ছোট বোন
সমীর আইচ
শিল্পী

আমার দাদার মৃত্যু হয়েছে অন্যের জন্য
লড়াই করতে গিয়ে। আমার দাদা শহিদ।

ছেলেটি এক মাস ধরে কষ্ট পেল। মুখ্যমন্ত্রী
থেকে প্রশাসন, কেউ আমল দিলেন না।
২০০৭ সালে রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পর প্রতিবাদ-মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন আমিরুল। এ দিন আমিরুলের জন্য আরও এক বার মিছিলে হাঁটল রিজের পাড়া। যার শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে নেমে পুলিশের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে আমিরুল ইসলাম আত্মঘাতী হয়েছেন বলে অভিযোগ, সেই কিশোরীর মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে মিছিলে এলেন। বললেন, “আমার মেয়ে ভয়ে-লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। আমার পাশে যে দাঁড়িয়েছিল, সেই ভাই-ই (আমিরুল) তো এখন নেই।” ওঁদের বাসার কাছেই সাকিরা বিবি-র ঘর। সাকিরা বলছিলেন, মাস দুয়েক আগেই স্থানীয় কিছু যুবক তাঁদের বাড়িতে চড়াও হলে আমিরুল কী ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, তখনও কড়েয়া থানার পুলিশ সাহায্য করেনি। নাবালিকার উপরে শাহজাদার অত্যাচারের কথা জানতেন সাকিরাও। বললেন, “শাহজাদার ভয়ে অনেক দিন ওরা মুখ বুজে ছিল। শাহজাদা বলত, টুঁ শব্দ করলে পুলিশকে বলে মিথ্যে অভিযোগে ওদের জেল খাটাবে। আমিরুল না-থাকলে ঘটনাটা কিছুতেই সামনে আসত না।”
আমিরুলের প্রতিবেশী, রিজের দাদা রুকবানুর এখন তৃণমূল বিধায়ক। এ দিনের মিছিলে তাঁকে কিন্তু দেখা যায়নি। রুকবানুরের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি অসুস্থ। তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। রিজের মৃত্যুর পরে প্রতিবাদকে যিনি আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিলেন সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলও এ বার কার্যত অনুপস্থিত। এমনকী, এই ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এখনও পর্যন্ত কেন একটি বাক্যও খরচ করেননি, এ দিন সেই প্রশ্নই উঠেছে। মিছিলে হাঁটেন পরিবর্তনপন্থী শিল্পী সমীর আইচ। তিনিও বলেন, “পুলিশের পরিবর্তন হয়নি। ছেলেটি এক মাস ধরে যখন কষ্ট পেল, তখনও মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রশাসনের কেউ আমল দিলেন না।”
যদিও সরকারের তরফে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ মানতে নারাজ সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি জোর গলায় দাবি করেন, “খুব গুরুত্ব দিয়েই ঘটনাটি দেখা হচ্ছে। পুলিশ যাতে ঠিকঠাক তদন্ত করে, তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” রাজ্য মহিলা কমিশনও আগের দিন আলাদা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। এ দিন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে আমিরুল-কাণ্ডে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। আমিরুলের মৃত্যুর তিন দিন পরে আরও বেশ কিছু তথ্য সামনে এসেছে। আমিরুল তাঁর প্রতিবেশী নাবালিকাকে নিয়ে প্রথম কড়েয়া থানায় যান অক্টোবরের ২৮ তারিখে। সে দিন পুলিশ শাহজাদা বক্সের বিরুদ্ধে কোনও কেস নেয়নি। পরে ৩১ অক্টোবর থানায় ফের গেলে পুলিশ লিখিত অভিযোগ নেয়। সে দিন ধর্ষণের কেস লেখাতে গেলে পুলিশ শ্লীলতাহানির অভিযোগ নেয়। এবং সেই দিনই শাহজাদার বাড়ির লোকজন থানায় গিয়ে আমিরুলের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করে আসেন। কিন্তু পুলিশ শ্লীলতাহানির কেস নিয়েছে দেখে, ওই নাবালিকার মা আবার থানায় গিয়ে ডিসেম্বরের ছ’তারিখে লিখিত ভাবে ধর্ষণের অভিযোগ করেন। এর ১৪ দিন পরে পুলিশ ওই নাবালিকাকে থানায় ডেকে পাঠিয়ে গোপন জবানবন্দি নেয়। তাতে ধর্ষণের কথা জানায় ওই নাবালিকা। পরে ২২ তারিখে শ্লীলতাহানির মামলা সংশোধন করে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু তখনও ওই নাবালিকার কোনও ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়নি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.