বরাবর সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ায় বিশ্বাস করেছেন তিনি। তাই শুক্রবার দুপুরে তাঁকেই ‘লিডারশিপ’ নিয়ে বলতে ডেকেছিল আইআইএম-কলকাতা।
বিদেশের মাটিতে তিনিই না কি জিততে শিখিয়েছেন ভারতকে। তাই আজ বাদে কাল কর্পোরেট কর্তা হিসেবে যাঁরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবেন, তাঁদের ক্লাস নেওয়ার ডাক পড়েছিল তাঁর।
আধ ঘণ্টার বক্তৃতা। তার পরের আরও আধ ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর। মিনিটের কাঁটা এক পাক ঘুরে আসার মধ্যেই দেশের প্রথম সারির ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়াদের মনের দখল নিয়ে নিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে নেতৃত্বের পাঠ পড়ালেন তিনি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন সাড়ে আটশো পড়ুয়া, শিক্ষকেরাও। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অধিনায়কের কাছে নেতৃত্বের রসায়ন বোঝার চাবি খুঁজলেন তাঁরা।
ইডেনে টাটকা হারের পর ধোনি নিয়ে প্রশ্ন আসা নিশ্চিত ছিল, এলও। উঠল গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে তেতো হয়ে যাওয়া সম্পর্কের কথা। এল সেই বিখ্যাত আগ্রাসী মনোভাবের প্রসঙ্গও। লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা ওড়ানো অধিনায়কের কাছে যা প্রত্যাশিত। এই সব কিছুকেই কর্পোরেট জীবনের সঙ্গে জুড়ে দিলেন সৌরভ। হবু সিইও-দের সামনে সহজ করে দিয়ে গেলেন নেতৃত্বের সংজ্ঞা। তাঁর ‘ট্রেড-মার্ক’ কভার ড্রাইভের মতো।
ক্রিকেট-জীবনে বার বার বোর্ড-রাজনীতির পাঁকে পড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সৌরভ মনে করেন, নেতা হওয়ার প্রথম শর্তই হল দলের বিশ্বাস আদায়। তাঁর মতে, “সকলে দেখতে চান নেতা যা বলছেন, বাস্তবে সেটা করছেনও।” সংস্থা বাঁচাতে খরচ ছাঁটাইয়ের কথা বলা সিইও-দের আকাশছোঁয়া বেতন নিয়ে বিতর্কের আবহে এই বক্তব্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। |
নেতার গুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জোর দিলেন সহকর্মীদের পাশে থাকার উপর। বিশেষত বিপদের দিনে। বললেন, প্রবল চাপের মুখে টেনশন শুষে নিয়ে বাকিদের জন্য পরিস্থিতি সহজ করার কথা। বোঝা গেল, কেন আজও ‘দাদা’ বলতে অজ্ঞান যুবরাজ বা হরভজনরা। এ দিনও এই পাশে থাকার হাতে-গরম নমুনা পেশ করলেন তিনি। বললেন, “লোকে বলে, আমার সময়টা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন ধোনির সময়টা আরও কঠিন। ও বড় ক্রিকেটার। কিন্তু প্রত্যেককেই এমন সময়ের মুখে পড়তে হয়।” সেই ধোনি, সৌরভের ‘অকাল অবসরের’ জন্য যাঁর দিকে আঙুল তোলেন অনেকে।
সৌরভ মনে করেন, ড্রেসিংরুমের মতো বোর্ড রুমেও ঠাণ্ডা লড়াই মেটানোর জন্য তৈরি থাকতে হবে। হেসে বললেন, এ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় না কি নেটে ব্যাট করার কম সময় পেতেন। তাঁর পরামর্শ, “বিশ্বাস হারিও না। সেঞ্চুরির কথা না ভেবে বরং জীবনের পিচেও রান কুড়োও একটু একটু করে। বিশ্বাস করো বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায়। আর চ্যাপেলের মতো ‘বস’ জুটলে? শুধু বলবে, সঙ্গে আছি। আমি যা করিনি।” রাজ্য, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতেও আদর্শ নেতা বা ‘হিরো’ জরুরি, বলে উল্লেখ করলেন তিনি।
আইআইএম-কলকাতার বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘ইন্টাগ্লিও-র মাঠে’ সৌরভের পরিচয় দিতে গিয়ে অধ্যাপক সুরেন সিস্তা বলেছিলেন, “ওঁর আসল মুকুট দলনায়ক হিসেবে।” অনেকেই বলেন নেতৃত্বে তাঁর দক্ষতা জন্মগত। প্রিন্স অফ ক্যালকাটা অবশ্য মনে করেন, “কেউ এই গুণ নিয়ে জন্মান। কেউ তা শিখে নেন। আসল নেতা তিনিই, যিনি পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সব কিছুর সঙ্গে যুঝে যাওয়ার মানসিক কাঠিন্য আছে যাঁর। চাঙ্গা করতে পারেন ঝিমিয়ে থাকা দলকেও।” ঠিক যে ভাবে তাঁর জমানায় বিদেশে চোখে চোখ রাখা রপ্ত করেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল।
আইআইএম-আমদাবাদে বিপণন ‘পড়াতে গিয়ে’ মুগ্ধ করেছিলেন আমির খান। এ দিন মুগ্ধ করলেন সৌরভও। তিনি ঢোকা মাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল অডিটোরিয়াম। সেই আবেগ অবশ্য বরাদ্দ ছিল স্টিভ ওয়-কে টসের আগে দাঁড় করিয়ে রাখা ‘কলার তোলা’ সৌরভের জন্য। কিন্তু শেষের হাততালিতে বোধ হয় শিক্ষকের জন্য তুলে রাখা শ্রদ্ধাও আদায় করে নিয়ে গেলেন তিনি। |