হরিপুরের প্রস্তাবিত প্রকল্প রুখে দেওয়া রাজ্যে দাঁড়িয়েই পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে শুক্রবার ফের তাঁরা ব্যাখ্যা করলেন, দেশের আর্থিক বিকাশ ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে পরমাণু বিদ্যুৎ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। জানালেন, কী কারণে তাপবিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুতের পাশাপাশি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনেও জোর দেওয়াটা জরুরি। পরিবেশবিদ-সহ বিশেষজ্ঞদের একাংশের আপত্তি থাকলেও বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে পরমাণু বিদ্যুৎকে পরিবেশ-অনুকূল ও কম বিপজ্জনক তথা গ্রিন এনার্জি বলেই আখ্যা দিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এ-ও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এতে জমিও লাগে অনেক কম।
বৃহস্পতিবার জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আহ্বান ছিল, আবেগ বা ভয় দিয়ে নয়। পরমাণু বিদ্যুৎ বা মহাকাশ গবেষণার মতো জটিল বিষয়কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত। এই জাতীয় বিষয়ে মতবিরোধ মেটাতে হলে প্রয়োজন বিতর্ক, বিশ্লেষণ ও সম্যক জ্ঞান। কার্যত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই এ দিন প্রতিফলিত হল বিজ্ঞানীদের কথায়।
হোমি ভাবা অধ্যাপক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক পরামশর্দাতা রাজাগোপাল চিদম্বরম থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়রা বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তাপবিদ্যুৎ বা অপ্রচলিত শক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যই প্রয়োজন আরও অনেক বেশি পরমাণু বিদ্যুৎ।
পরিবেশ দূষণের প্রশ্নে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দেশ জুড়ে বিতর্ক চলছে। যে যুক্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পূর্ব মেদিনীপুরের হরিপুরে প্রস্তাবিত ৬ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে ছাড়পত্র দেননি। লাগাতার প্রতিবাদ চলছে মহারাষ্ট্রের জয়তাপুরে ৯৯০০ মেগাওয়াট পরমাণুু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের পরমাণু প্রকল্পটি এখন চালু হওয়ার মুখে। তবু সব বিরোধিতা দূর করা যায়নি এখনও।
বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে বক্তারা এ দিন গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দাবি করেন, ‘নিউক্লিয়ার এনার্জি ইজ গ্রিন।’ তাঁরা জানান, তাপ বিদ্যুৎ-সহ অন্য যে কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়েছে, পরমাণু প্রকল্পে তেমন ঘটনা নগণ্য। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরুদ্ধে বড় প্রতিবাদের কারণ, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। সে কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা মনে করিয়ে দেন, পৃথিবীর মাটি বা মহাজাগতিক রশ্মি সর্বক্ষণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি তাতে যেটুকু তেজস্ক্রিয়তা যোগ করে, তার পরিমাণ বা মাত্রা অতি নগণ্য।
শ্রীকুমারবাবু জানান, কয়লা ফুরিয়ে আসছে। তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি পাওয়াটাও সমস্যা হয়ে উঠছে। সে দিক দিয়ে দেখলেও পরমাণু বিদ্যুৎই সময়োপযোগী সমাধান। কারণ, হাজার মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে অন্তত ৭০ হেক্টর জমি দরকার। আর সমান ক্ষমতার একটি পরমাণু কেন্দ্রের জন্য ২০ হেক্টর জমি হলেই চলে। নিরাপত্তার কারণে মূল প্রকল্পকে ঘিরে যে জমি ছাড়তে হয়, এ হিসেব সেটাকে ধরেই।
তবে বিজ্ঞানীরা সওয়াল করলেও এ দেশে পরিবেশবিদ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক বিশেষজ্ঞ কিন্তু এখনও পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কাকে তাঁরা অমূলক মনে করেন না। চেরনোবিলের দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে ফুকুশিমা দাইচির বিপর্যয়ই তার উদারণ। শক্তি বিশেষজ্ঞ সুজয় বসু যেমন মনে করিয়ে দিয়েছেন, উন্নত দেশগুলিতে এখন পরমাণু বিদ্যুতের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইউরোপ-আমেরিকার কোথাও নতুন কোনও পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে না। কেন? তার যুক্তি হিসেবে সুজয়বাবু অভিযোগের আঙুল তুলেছেন পরমাণু বিদ্যুতের বর্জ্যের দিকে। তাঁর মতে, ওই বর্জ্য পরিবেশের পক্ষে ভয়ঙ্কর। ওই বর্জ্যের শোধন বা পুর্নব্যবহারের পদ্ধতি কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
এই সব বিতর্কের মধ্যেও অবশ্য পরমাণু শক্তি বিষয়ক মন্ত্রক ২০৩২ সালের মধ্যে ভারতে ৫৭ হাজার মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। বর্তমানে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর সমর্থনে শ্রীকুমারবাবুদের যুক্তি, সৌর বিদ্যুতে সারা দেশে ট্রেন চালানো যাবে না। তাপ বিদ্যুতের জন্য কয়লার ব্যবহারও যে করেই হোক কমাতে হবে। আর সেই ফাঁক ভরাতেও পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। একই মত যোজনা কমিশনের সদস্য কে কস্তুরিরঙ্গনেরও। তাঁরও বক্তব্য, “বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, জল ও বায়ুর পাশাপাশি পরমাণু শক্তির উপরেও জোর দিতে হবে।”
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সমাজ কল্যাণের স্বার্থেও এটা জরুরি।
দেশের মানব উন্নয়ন সূচক বাড়াতে হলে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে সারা দেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার বছরে ৭০৪ কিলোওয়াট-আওয়ার। পৃথিবীর যে কোনও উন্নত দেশে যা বছরে ৮ থেকে ১৫ হাজার কিলোওয়াট-আওয়ার। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর স্বার্থেই আগামী এক দশকে ভারতে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার বছরে ৫ হাজার কিলোওয়াটে-আওয়ারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর সেই চাহিদা মেটাতে তাপ বিদ্যুতের পাশাপাশি অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার অবশ্যই বাড়াতে হবে। প্রয়োজন বাড়তি পরমাণু বিদ্যুতেরও। নয়তো অধরাই থেকে যাবে ওই লক্ষ্য। |