|
|
|
|
বিপজ্জনক ভাবেই নদীপথে চলছে বর্ষশুরুর পিকনিক |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নবদ্বীপ |
নববর্ষের সকালে নৌকা ছেড়েছিল। জলপথে সারা দিন ধরে পিকনিক। নৌকার মধ্যে জোরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য। নৌকায় খাদ্য পানীয় পর্যাপ্ত মজুত। গঙ্গা বা জলঙ্গির বুকে সারা দিন খানাপিনা সেরে বাড়ি ফেরার পথে নাচের ঝোঁক সামলাতে না পেরে নৌকা থেকে নদীতে পড়ে গেলেন সুশীল দাস। বাড়ি নবদ্বীপের চরব্রহ্মনগর। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মায়াপুরের কাছে গঙ্গায় দুর্ঘটনা হলেও বুধবার বিকেল পর্যন্ত তাঁর দেহ উদ্ধার করা যায়নি। এমনিতেই কুয়াশায় সকালে পিকনিকে যাওয়ার সময় বা সন্ধ্যায় ফেরার পথে পথ দেখাই মুশকিল। তার উপর পিকনিকের নামে খুলে যায় মনের আগল। তাই পিকনিকের এই মরসুমে বিপদ ওঁত পেতে থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
হুক করে টানা হচ্ছে বিদ্যুৎএই চিত্রই দেখা গেল নববর্ষের রাতে। সুশীলবাবুর খোঁজে যখন গঙ্গায় নৌকা জাল নিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে, তখনই আবার দেখা গেল একটি আলোকিত নৌকা। জোরালো আলোয় অন্ধকার নদীর চারপাশ ধাঁধিয়ে পিননিকে বেরিয়েছে এক দল যুবক। নৌকার দু’দিকে দশটি করে দুড়িটি মাইকে গগনভেদী আওয়াজে চলছে গান। খোলা পাটাতনে নাচছেন এক সঙ্গে অনেকে। পূর্বস্থলী থেকে আসছিল নৌকাটি।
মঙ্গলবার বেলা বাড়তেই জাতীয় ও রাজ্য সড়ক ধরে দেখা গেল পিকনিকের একাধিক গাড়ি। সামনের একটি গাড়িতে মাইক, বক্স। তা থেকে যে গানের শব্দ বেরোচ্ছে তাতে আশপাশের মানুষ চমকে উঠে তাকাচ্ছেন। ঠিক পিছনে একটি ছোট লরিতে উদ্দাম নাচ। কেউ কেউ বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়ছেন।
এখানেই শেষ নয়। মায়াপুর-বামুনপুকুরের বিভিন্ন মাঠে গাড়ি থামিয়ে চলছে পিকনিক। মাঠের উপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার থেকে হুক করে লাইন টেনে বাজানো হচ্ছে বক্স। |
|
ছুটির মরসুমে নৌকায় পিকনিক। —নিজস্ব চিত্র। |
সুরক্ষা নিয়ে ভাবে না কেউ দিনে বা রাতে এই রকম বিপজ্জনক ভাবেই চলছে পিকনিক মরসুম। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, পিকনিক করতে যাওয়ার সময়ে গাড়িগুলিও চলে বিপজ্জনক ভাবে। কখনও খুব দ্রুত। তার উপর মদ্যপ অবস্থায় থাকে চালক ও সওয়ারিরা। তবে নিঃসন্দেহে সব থেকে বিপজ্জনক নৌকার বুকে পিকনিক। নবদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এবং নবদ্বীপ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি হরিদাস দেবনাথ বলেন, “নদীতে বেপরোয়া পিকনিক যে কোনও মূল্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। পুলিশ-প্রশাসনের পাশাপাশি, যাঁরা নৌকা চালাচ্ছেন, তাঁদেরও কড়া হওয়া দরকার।” স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই নৌকাগুলিতে অনেক সময়েই যতটা ভার তোলা উচিত, তার থেকে অনেক বেশি লোকজন তোলা হয়। শীতের গঙ্গায় এখন জল ভালই রয়েছে। তবু লাইফ জ্যাকেট রাখার নিয়মকে কেউ তোয়াক্কাই করেন না। এমনকী অনেক সময়ে যে মাঝিরা থাকেন, তাঁরাও অভিজ্ঞ নন। সুশীলবাবু যে নৌকাটি থেকে পড়ে গিয়েছেন, সেই নৌকাটি ব্যক্তিগত। এই ধরনের নৌকাই বেশি ব্যবহৃত হয় পিকনিকের ক্ষেত্রে। তবে একই সঙ্গে নবদ্বীপ-মায়াপুর-স্বরূপগঞ্জের মধ্যে নবদ্বীপ জলপথ পরিবহণ দফতরের যে নৌকা চলে, তার কিছু পিকনিকের মরসুমে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও নিরাপত্তার সমস্ত দিকগুলি ঠিক ভাবে মানা হয় না। নৌকায় মদ্যপান নিষিদ্ধ নবদ্বীপ থানার আইসি কপন মিশ্র বলেন, “যাঁর দুর্ঘটনা হয়েছে, তাঁর বাড়ির লোক অভিযোগ দায়ের করলে আমরা ওই নোকার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করব। এ ছাড়া সমস্ত নৌকার মালিকদের ডাকা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পিকনিকের জন্য পুলিশের অনুমতি ছাড়া নৌকা ভাড়া দেওয়া যাবে না। পিকনিকের নৌকায় মদ্যপান নিষিদ্ধ।” এই নিষেধাজ্ঞা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালের নৌকা থেকে পড়ে পিকনিকের দলের এক জনের মৃত্যু হয়। তারপরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে নৌকার নিরাপত্তা ও ভাড়ার শর্তাবলি তৈরি করে। কিন্তু হুঁশ ফেরেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, পিকনিকে যিনি নৌকা ভাড়া দিচ্ছেন এবং যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদের কেউই দুর্ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ মাথা ঘামান না। এই পরিবেশটাই পরিবর্তন করা দরকার। এক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা এমনই পিকনিকে গিয়ে দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন এক ছাত্রী। ভুক্তভোগী শ্রীতমা গুপ্তের বক্তব্য, “বাধ্য হয়ে দলে পড়ে নৌকায় পিকনিক করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নৌকা বিপজ্জনক ভাবে দুলছে দেখেও আমাদের দলের ছেলেদের নাচ থামেনি। ফেরার সময়ে তাঁদের অনেকে মদ ও গাঁজা খেয়ে বেহুঁশ ছিলেন। কেউ কেউ বেশি সাহস দেখাতেও চেষ্টা করছিলেন। পিকনিক করতে গিয়ে তাই সারাটা দিন দুঃস্বপ্নের মতোই কেটেছে। সব সময় আশঙ্কায় থেকেছি, এখনই কিছু ঘটে যেতে পারে। সুশীলবাবুর ঘটনা প্রমাণ করে, আমার আশঙ্কা মিথ্যা ছিল না।” |
|
|
|
|
|