পার্ক স্ট্রিটের চেলো কাবাব। কে সি দাসের রসগোল্লা। নিউ মার্কেটের কেনাকাটা।
এর মধ্যে কোথায় বা জঙ্গি হামলা, কোথায় বা নিয়ন্ত্রণরেখা, আর কোথায় বা দ্বিপাক্ষিক জটিলতা?
ইডেনে ভারত-পাক ম্যাচের আগের দিনই কলকাতায় এসে পড়েছেন পাকিস্তানের ইরফান মুস্তাফা। বুধবার সন্ধ্যায় এ জে সি বসু রোডের হোটেলে বসে বললেন, “এ শহরে প্রথম এলাম। আমার তো মনে হল লাহৌরের রাস্তাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
এতটাই সহজ আর ঘরোয়া বোধ করছেন ওঁরা! দু’দেশের মধ্যে সংশয়-সন্দেহের যে বাতাবরণ, কলকাতায় সেটা টের পাননি ইরফানের পরিবার! “কই, কেউ তো জিজ্ঞেস করল না কোথা থেকে এসেছি? রেস্তোঁরায় বসে দিব্যি খেলাম, কেনাকাটা করলাম।” আজ, খেলা দেখবেন সপরিবার।
ইডেনেরই উল্টো দিকে পাঁচিলে বসে পা দোলাচ্ছিলেন ৬০ বছরের মহম্মদ বশির। দিন দুয়েক আগে কলকাতায় এসেছেন এই পাক ব্যবসায়ী। ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, পাকিস্তান জিতেগা’ বলে চিৎকার করায় বুধবার দুপুরে ক্লাবহাউসের সামনে এক দল যুবক ঘিরে ধরেছিলেন তাঁকে। কোনও রকমে নিস্তার পেয়ে এক গাল হেসে বললেন, “আরে দূর! ইয়ে তো মুহব্বত সে ঘের লিয়া হামকো। আমার বিবি তো প্রায়ই তেড়ে আসে।”
কেন? বিবির সঙ্গে বশিরের কীসের ঝগড়া? |
ঝগড়া না হয়ে উপায় কী? বশিরের স্ত্রী যে আদতে হায়দরাবাদের মেয়ে। নিজেদের বিয়েটাকে অনেকটা শোয়েব-সানিয়ার বিয়ের মতোই মনে করেন ওঁরা। বশিরের কথায়, “আমার শরীর পাকিস্তানের। তাই পাকিস্তান জিতলে আনন্দ হয়। আবার আমার বিবির জন্য মনটা ভারতের। ভারত জিতলেও মজা হয়।”
আজমল কসাবের ফাঁসির অনতিবিলম্বে স্রেফ ক্রিকেট দেখতে এসে শান্তির বার্তা দিয়ে গেলেন স্ব-ঘোষিত এই দুই পাকিস্তানি দূত।
দু’জনেরই বক্তব্য এক আরও বেশি মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া উচিত দুই দেশের নাগরিকদের। ইরফান মুস্তাফার কথায়, “যতটা স্বাভাবিক ভাবে আমরা আপনাদের শহরে ঘুরে বেড়ালাম, করাচি বা লাহৌর শহরেও যে কোনও বাঙালি এ ভাবেই ঘুরে বেড়াতে পারবেন। কেউ ঘৃণার চোখে দেখবে না।” ইরফানের মতে, দু’দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’র অনেকটাই রাজনৈতিক নেতাদের তৈরি করা ধারণা। আরও বেশি ভারতীয় পাকিস্তানে বেড়াতে গেলে, আরও বেশি সংখ্যায় পাক নাগরিকদের ভারতে আসতে দিলে এই ধারণা অচিরেই ভেঙে যাবে।
ইরফানের দুই ছেলে হ্যারিস ও জিবরান মুস্তাফা। এক জনের বয়স ৩১, অন্য জনের ২৯। তাঁরা দুবাইয়ে থাকেন। জিম করা পেটানো চেহারা। এক সময় দু’জনেই ক্রিকেট খেলতেন। এখন কাজ আর ব্যবসার চাপে হয়ে ওঠে না। কলকাতায় আসার আগেই দুই ভাই নেট-এ বসে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, শহরে কোন কোন খাবার বিখ্যাত। নোট-প্যাডে রেস্তোঁরার দীর্ঘ তালিকা। হ্যারিস বলেন, “শুক্রবার দিল্লি যাওয়ার আগে যত বেশি সম্ভব খাবার চেখে দেখার চেষ্টা করব।” |
মহম্মদ বশিরের আবার নিজেরই রেস্তোরাঁর ব্যবসা। শিকাগোয় বিরিয়ানির রেস্তোঁরা রয়েছে তাঁর। শিকাগোতেই পাকাপাকি ভাবে বাস করেন। চার বার হার্ট অ্যটাকের পরে এখন দিনে ১২টা করে ট্যাবলেট খেতে হয়। বললেন, “বিবি কিছুতেই আসতে দিচ্ছিল না। জোর করেই এসেছি। ১৫ জুন বার্মিংহামে ভারত-পাক ম্যাচের টিকিটও তাই আগেভাগে কেটে রেখেছি।” এই নেশার জন্যই অনেক ক্রিকেটারও তাঁকে চেনেন। বশিরের কাছে ইডেনের টিকিট ছিল না। দিন দুই আগে চেন্নাই থেকে কলকাতায় আসার সময়ে বিমানে অরুণ লাল তাঁকে দেখে চিনতে পেরে একটা টিকিট দিয়েছেন।
ময়দানে গাছের তলায় এক দল অত্যুৎসাহী যুবক বশিরকে বললেন, “আমরাও আপনার মতো পাকিস্তানের সমর্থক।” বশির কিন্তু কথাটা শুনে উৎফুল্ল হলেন না! “দেশের মানুষ দেশকে সমর্থন করবে, এটাই তো স্বাভাবিক! আমার মা তা-ই শিখিয়েছিলেন”, বললেন তিনি! |