|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
বিপ্লবের জন্ম |
২০১৩ সালের বয়স মাত্র তিন দিন। ভারতে এই বৎসরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি কী হইবে, তাহা এখনই অনুমান করা কঠিন। কিন্তু ২০১৩-র সালতামামিতে যাহাকে গুরুত্ব না দেওয়া অসম্ভব হইবে, তাহার নাম ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার বা সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর। ১ জানুয়ারি দেশের ছয়টি রাজ্যের মোট ২০টি জেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবস্থাটি চালু হইল। বিভিন্ন খাতে রাজকোষ হইতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তাহার একটি অংশ সরাসরি মানুষের হাতে পৌঁছাইবে। আধার কার্ডের মাধ্যমে নাম নথিভুক্ত করিয়া সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। ইহা এক বহুমাত্রিক বিপ্লব। প্রথমত, সরকার এবং প্রাপকের মধ্যে যদি সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তবে বহুবিধ মধ্যস্বত্বভোগীকে প্রক্রিয়াটির বাহিরে রাখা সম্ভব হইবে। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন একটি হিসাব দিয়াছিলেন— সরকার গরিবের উদ্দেশে এক টাকা ব্যয় করিলে শেষ পর্যন্ত তাঁহাদের হাতে বড় জোর ১৫ পয়সা পৌঁছায়। রাজীব গাঁধী প্রায় ২২ বৎসর পূর্বে নিহত হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার এই দুর্ভাগ্যজনক হিসাবটি এখনও বেশ রকম সত্য। সরাসরি সুবিধা হস্তান্তরের ব্যবস্থা চালু হইলেই একমাত্র তাহা বদলাইতে পারে। বিপ্লবের দ্বিতীয় ভাগ হইল, এই ব্যবস্থাটি বায়োমেট্রিক তথ্যের ভিত্তিতে চলিবে। তাহাতে দুর্নীতি আরও এক দফা কমিবে। বস্তুত বিশ্বের কোথাও এত বড় মাপের কোনও প্রকল্প বায়োমেট্রিক তথ্যের ভিত্তিতে চলে নাই। ভারতই পথিকৃৎ। এই ঘটনার অভিঘাতে ভবিষ্যতের দুনিয়ার ছবিটি সম্পূর্ণ অন্য রকম হইতে পারে— তাহাতে ভারতের নেতৃত্ব অনস্বীকার্য হইবে।
বিপ্লবের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ দিক হইল, সরাসরি সুবিধা হস্তান্তরের প্রকল্পের মাধ্যমে আধার তাহার অভিপ্রেত কাজে ব্যবহৃত হইতেছে। এই একশত ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে কে কী অবস্থায় রহিয়াছে, কাহার কী প্রয়োজন, তাহা সরকারের পক্ষে নিশ্চিত করিয়া জানা এক প্রকার অসম্ভব। তাহার জন্য নির্দিষ্ট ভাবে জানা প্রয়োজন, কোন মানুষটি কোথায়, কী অবস্থায় আছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেই সম্পূর্ণ চিহ্নিতকরণ অবশ্যই সম্ভব। আধার সেই কাজটিই করিতেছে। আপাতত যে ভর্তুকি সরাসরি প্রাপকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হইবে, তাহা সামান্যই, অন্তত আধারের সম্ভাবনার পরিধির তুলনায়। যে সর্বজনীন উন্নয়নের কথা রাজনীতিকদের মুখে লাগিয়াই থাকে, তাহাকে বাস্তব করিতে চাহিলে আধারের বিকল্প নাই। আর্থিক বৃদ্ধির সুফল কাহার নিকট কোন পথে পাঠাইতে হইবে, আধার তাহার সম্ভাবনার নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিল। সরকার সেই সম্ভাবনাকে কত দূর ব্যবহার করিতে পারিবে, প্রকল্পটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হইবে কি না, সেই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু সম্ভাবনা যে তৈরি করা গিয়াছে, তাহাই বিরাট সাফল্য। বস্তুত, শুধু বিভিন্ন স্তরের সরকারি প্রশাসন নয়, সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব এই প্রকল্পকে সফল করা।
সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর প্রকল্প লইয়া অনেকগুলি আশঙ্কা তৈরি হইয়াছে, সত্য। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অসুবিধা হইতেছে, তাহাও ঘটনা। কোথাও অনেক মানুষের নিকট আধার নম্বর পৌঁছায় নাই। কোথাও পরিচিতি-যাচক যন্ত্রে আঙুলের ছাপ মিলিতেছে না। সমস্যাগুলি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। কিন্তু তাহা নিতান্তই প্রায়োগিক সমস্যা। তাহা কাটাইয়া উঠা সম্ভব, কাটাইয়া উঠাই বিধেয়। সেই সমস্যাগুলির দিকে আঙুল তুলিয়া প্রকল্পটিকে নস্যাৎ করিবার কোনও অর্থই হয় না। গোড়ার দিকে কিছু অসুবিধা থাকিবে, তাহা এক প্রকার প্রত্যাশিত। অতি দ্রুত উদ্যোগী হইয়া সেই সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। যত কম মানুষকে যত কম অসুবিধায় ফেলিয়া প্রকল্পটি চালু করা যায়, ততই ভাল। তবে, নূতনকে ভয় পাইয়া কেহ এই প্রকল্পের বিরোধিতা করিলে তাহাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নাই। ভারতে যখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করা হইল, তখনও অনেকেই হাজার প্রশ্ন খাড়া করিয়াছিলেন। তাহারও পূর্বে, কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সেই একই রকম আপত্তি উঠিয়াছিল। সময় সেই আশঙ্কাগুলিকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করিয়াছে। সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর সংক্রান্ত আশঙ্কাও একই ভাবে ভুল প্রমাণিত হইবে। |
|
|
|
|
|