|
|
|
|
আমার মৃত্যুতেও বন্ধ কোরো না প্রতিবাদ |
রিজের মতোই শেষ ইচ্ছে আমিরুলের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
আবার সেই কড়েয়া। আবার প্রায় একই চিঠি। যার মূল কথা, আমার চলে যাওয়ার পরে আওয়াজ তুলো।
প্রথম ঘটনাটি পাঁচ বছর আগে। মৃত্যুর আগে এক যুবক এসএমএস করেছিলেন, ‘মেরে জানে কে বাদ আওয়াজ উঠানা।’ কড়েয়া থানার বাসিন্দা সেই যুবকের নাম রিজওয়ানুর রহমান।
এ বার প্রতিবাদী যুবকের নাম মির আমিরুল ইসলাম, নাবালিকাকে ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় যাঁকে পুলিশ ও দুষ্কৃতীদের হাতে নিগৃহীত হয় বলে অভিযোগ। এবং যে হেনস্থার পরে তিনি গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার আগে বাবা-মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলে যান, ‘আমার মৃত্যুর পর পুলিশের সঙ্গে শাহজাদার আঁতাঁত নিয়ে তোমরা আওয়াজ তোলা বন্ধ কোরো না।’
আশ্চর্য সমাপতন! দু’জনে শুধু কড়েয়া থানার বাসিন্দাই নন, দু’জনের প্রতিবাদই পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়ার বিরুদ্ধে। ইংরেজির স্নাতক রিজওয়ানুরের বিয়ের ব্যাপারে পুলিশ হস্তক্ষেপ করেছিল বলে অভিযোগ। তিনি সেই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বলেছিলেন। নাবালিকা ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় হেনস্থা হতে হয় বাণিজ্যের স্নাতক আমিরুল ওরফে গুড্ডুকে। তিনি বলে গেলেন সেই ঘটনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে। |
|
আত্মহত্যার আগে বাবা-মাকে লেখা আমিরুলের সেই চিঠি। |
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ধর্ষণের শিকার ওই নাবালিকা ইংরেজি লিখতে পারতেন না বলে আমিরুলই তাঁকে কড়েয়া থানায় নিয়ে যান অভিযোগ দায়ের করাতে। সেটা ৩১ অক্টোবর। এলাকার প্রভাবশালী শাহজাদা বক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করাও হয়। তার পরেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আমিরুলের উপরে শাহজাদা এবং পুলিশ চাপ বাড়াতে শুরু করে বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, পাল্টা চাপ দিতে আমিরুলের বিরুদ্ধেই ডাকাতির মামলা দায়ের করা হয়। আমিরুল অভিযোগ করেছিলেন, শাহজাদার সঙ্গে পুলিশের একাংশের দহরম-মহরম রয়েছে। তাই পাল্টা মামলা দায়ের করে তাঁকে হেনস্থা ও নিগ্রহ করা হচ্ছে।
এর পরেই ৩ ডিসেম্বর এই হেনস্থার প্রতিবাদে কড়েয়া থানার সামনে গায়ে আগুন দেন আমিরুল। তার আগে বাবা-মাকে এই চিঠি লেখেন তিনি। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য শাহজাদা (ধর্ষণের অভিযুক্ত) এবং পুলিশ দায়ী।’ গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাঁকে সে দিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারি সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
৩ ডিসেম্বরই পুলিশ আমিরুলের জবানবন্দি নেয়। ওই জবানবন্দিতে তিনি বলেন, “কড়েয়া থানার অফিসার রঞ্জিত যাদব এবং বিনোদ কুমার ওই শাহজাদার পক্ষ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। ধর্ষণের অভিযোগ লেখানো সত্ত্বেও তাঁরা এখনও শাহজাদাকে গ্রেফতার করেননি।” পর দিন, ৪ ডিসেম্বর শাহজাদাকে গ্রেফতার করা হয়। আমিরুলের পরিবার প্রশ্ন তুলেছে, ৩১ অক্টোবর ধর্ষণের অভিযোগ করার পরেও ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শাহজাদা কী ভাবে এলাকায় ঘুরে বেড়ালেন? কেন নাম করে অভিযোগ করার পরেও ওই দুই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ এ দিন বলেন, “এখনও পর্যন্ত কোনও পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কড়েয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। অভিযোগ পেলেই তা খতিয়ে দেখা হবে। হাসপাতালে আমিরুলের জবানবন্দি পুলিশ নথিভুক্ত করেছে। তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” অভিযুক্ত দুই অফিসারের সঙ্গে কথা বলার জন্য এ দিন কড়েয়া থানায় যাওয়া হলে ওসি জানান, এই ব্যাপারে কথা বলার কোনও এক্তিয়ার তাঁদের নেই।
আমিরুলের মা শাহনাজ ইজহার বুধবারই আইনি পদক্ষেপ করেছেন। তিনি পুলিশের সঙ্গে শাহজাদার যোগসাজশের ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেছেন। যে মেয়েটিকে শাহজাদা টানা এক বছর ধরে ধর্ষণ করছে বলে অভিযোগ, তাঁর মা-ও এ দিন শাহজাদা, তার সঙ্গী এবং কয়েক জন পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর মেয়েকে অপহরণ ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার জন্য শাহজাদার বিরুদ্ধে বুধবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় মামলা করা হয়েছে। |
|
কড়েয়া থানার ভূমিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ স্থানীয়দের। —নিজস্ব চিত্র |
এতে অবশ্য ওই মেয়েটি ও আমিরুলের পরিবারের ক্ষোভ কমেনি। বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চার নম্বর ব্রিজের মুখে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান এলাকার বাসিন্দারা। আমিরুলের আইনজীবী নৌসাদ হুসেন জানিয়েছেন, শুক্রবার দুপুরে এলাকায় তাঁরা ন্যায়ের দাবিতে মোমবাতি-মিছিল করবেন। আমিরুলের মাকে নিয়ে দেখা করতে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের সঙ্গে। ৬ জানুয়ারি তাঁরা আদালতে একটি ‘রিট পিটিশন’ করবেন বলেও নৌসাদ জানান।
নৌসাদের অভিযোগ, “৩১ অক্টোবর কড়েয়ায় যে ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়, তার কেস নম্বর ছিল ৪৮৪। ঠিক পরের কেসটিই ছিল আমিরুলের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগের। ওই কেসটি করেছে শাহজাদার স্ত্রী। তাঁর অভিযোগ ছিল, আমিরুল তাঁদের বাড়িতে ডাকাতি করেছে। শুধু তা-ই নয়, শাহজাদার স্ত্রীর অভিযোগ অনুযায়ী, প্রথমে আমিরুলের বিরুদ্ধে কেস হয়েছিল ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারায় (চুরি)। তিন দিন পরে তা বদলে ৩৯৫ ধারায় ডাকাতির মামলা রুজু করা হয়।”
নৌসাদের এই দাবি অবশ্য মানতে চাননি শাহজাদার স্ত্রী নিলোফার বেগম। এ দিন ২৯এ/৪২ পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে তালা লাগানো কোলাপসিবল গেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “গুড্ডু (আমিরুল) ৩১ অক্টোবর বিকেলে দলবল নিয়ে তালা ভেঙে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকে। তখন বাড়িতে কোনও পুরুষমানুষ ছিল না। ওরা আলমারি ভেঙে টাকা নেয়। আমার গলার সোনার চেন টেনে নিয়ে যায়। ইট ছোড়ে। তাতে আমার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” তাঁর আরও অভিযোগ, “মেয়েটি মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ আনছে। ওর চরিত্র মোটেই ভাল নয়।”
বুধবার দুপুরে আমিরুলদের বাড়িতে বসে এই অভিযোগ শুনে কিছু ক্ষণ চুপ করে ছিলেন বছর ষোলোর ছোটখাটো চেহারার ওই কিশোরী। থাকেন শাহজাদার বাড়ির কাছেই। দিদিমা লোকের বাড়ি কাজ করেন। মা-বাবা বারুইপুরে কাজ করেন। তাঁর কথায়, “বছরখানেক আগে এক দিন শাহজাদা আমাকে চার নম্বর ব্রিজের কাছে আসতে বলে। বলল, কিছু জিনিস কিনেছে। সেটা বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে যাওয়ার পর জোর করে বোটিং ক্লাবে নিয়ে খারাপ কাজ করে। তার পর বলে, কাউকে জানালে অ্যাসিড মারবে। মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে খুন করবে।” কিশোরী জানায়, “এর পর নিলোফার বাজারে বা বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে গেলেই শাহজাদা আমাকে ডেকে খারাপ কাজ করত। যাব না বললে খুনের হুমকি দিত। কাজ করার পর আমাকে একটা ট্যাবলেট খেতে দিত। বলত, এটা খেলে স্বাস্থ্য ভাল হবে। পেটে বাচ্চাও আসবে না।”
কিশোরী আরও জানান, অক্টোবর থেকে তাঁর শরীর এত খারাপ হতে থাকে যে, দিদিমা এবং কয়েক জন বন্ধুকে ঘটনাটি জানাতে বাধ্য হন তিনি। “দিদিমা জানান গুড্ডুদাকে (আমিরুল)। তিনিই তখন থানায় নিয়ে যান।” কিশোরীর অভিযোগ, “পুলিশ অফিসার বিনোদ কুমার, কনস্টেবল নাসিম খান থানায় বসে আমাকেই ধমক দিতে থাকেন। বলতে থাকেন, আমি মিথ্যা কথা বলছি। মহিলা অফিসার জেরা করার সময় আমি যা যা বলছিলাম, সব বিনোদ কুমার থানায় বসেই টেলিফোনে শাহজাদাকে জানাচ্ছিলেন।” কিশোরীর অভিযোগ, “গত রবিবার ও মঙ্গলবার শাহজাদার
দলবল বন্দুক ও খুর নিয়ে বাড়িতে চড়াও হয়। আমাকে অভিযোগ তুলে নিতে বলে। ভয়ে বাইরে বেরোতে পারছি না। বারবার অনুরোধ করার পরেও পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না।” |
|
|
|
|
|