তৃণমূলে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্বে এ বার জড়ালেন সৌগত-মুকুল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
খাস তৃণমূলের অন্দরেই ‘আমরা-ওরা’! পুরনো সৈনিক না নব্য সম্প্রদায়, শাসক দলের মধ্যে কারা বেশি গুরুত্ব পাবে, সেই প্রশ্নে মঙ্গলবার তরজায় জড়ালেন দলের দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সাংসদ সৌগত রায়ের আক্ষেপ, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে দলের সাফল্যের পরে যাঁরা তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরাই এখন চলে এসেছেন সামনের সারিতে। তাঁর দাবি, দল চালানোয় গুরুত্ব পাওয়া উচিত পুরনোদেরই। এমন দাবি সৌগতবাবু দলীয় মঞ্চে আগেও করেছেন। দলে পূর্ণেন্দু বসু, দোলা সেনদের কর্তৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে একই কথা বলতে চেয়েছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়রা।
কিন্তু মঙ্গলবার যা ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব! মধ্যমগ্রামে একই মঞ্চ থেকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় সৌগতবাবুর দাবি উড়িয়ে কটাক্ষ করে বলেছেন, “১৯৯৮ সালে যখন ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তৃণমূল তৈরি হয়েছিল, অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধাই তখন দলে আসেননি। এসেছেন পরে!” তাঁর প্রশ্ন, সকলে মিলে যখন সিপিএমকে হারানোর লক্ষ্য অর্জন হয়েই গিয়েছে, তা হলে আর কে আগে এসেছেন, কে পরে সেই বিতর্ক তুলে লাভ কী? |
মুকুলবাবু নাম না-করলেও তাঁর এ দিনের কটাক্ষের লক্ষ্য যে সৌগতবাবুই তা স্পষ্ট। কারণ, ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের সময় কংগ্রেস ছেড়ে মমতার সঙ্গে আসেননি সৌগতবাবু। উল্টে সে বছর লোকসভা ভোটে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব এ ভাবে প্রকাশ্যে এসে পড়ায় উদ্বিগ্ন তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তাঁদের মতে, দুই নেতার বক্তব্যেই যুক্তি আছে। কিন্তু এমনিতেই রাজ্যের নানা জায়গায় দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে। এখন এ ভাবে তরজা চললে দলে পুরনো ও নতুন অংশের মধ্যে বিভাজন আরও প্রকট হবে যা পঞ্চায়েত ভোটের আগে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব আরও উস্কে দেবে।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “দল ক্ষমতায় চলে এসেছে বলেই পুরনো সৈনিকদের উপেক্ষা করা উচিত নয়, এ কথা ঠিক। আবার যাঁরা বহু দিন ধরে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, তাঁদের একক লড়াইয়ে দলের সাফল্য আসেনি। পরে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের পাশে নিয়ে যৌথ লড়াইয়েই আমরা সফল হয়েছি।” দু’তরফের যুক্তিই যে শাসক দলে গ্রহণযোগ্য, তার নমুনা মঙ্গলবার মধ্যমগ্রামেই মিলেছে। সৌগতবাবু এবং মুকুলবাবু, অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’জনেই কর্মী-সমর্থকদের হাততালি পেয়েছেন!
দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে মধ্যমগ্রামে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয় লাগোয়া একটি সভাকক্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল। ওই সভাকক্ষে দলীয় কর্মীদের নিয়ে কর্মশালা হয়। সেই মঞ্চে তরজায় জড়িয়ে পড়েন দুই নেতা। ছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ত্রাণমন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষ প্রমুখ।
দমদমের সাংসদ সৌগতবাবু প্রথমে বলেন, “যাঁরা ২০০৯-এর আগে তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সাক্ষী। তাঁদের গুরুত্ব দিতে হবে। এই জন্যই আমি বারবার বলি, ২০০৯-কে লাইন ধরতে হবে। যাঁরা পরে এসেছেন, তাঁরা লাইনের এ’পারে থাকবেন।” সৌগতবাবুর বক্তব্য, “যে হেতু আমরা শাসক দল, তাই চেয়ারমান, কাউন্সিলরের মতো জনপ্রতিনিধি, বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য কিছু লোক ২০০৯-র পরে দলে এসেছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক উচ্চাশা থাকেই। কিন্তু কিছু নেতা আছেন, যাঁরা জনপ্রিয়তা পেতে পরে আসা এই সমস্ত ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে দলের পবিত্রতা নষ্ট হবে!”
পরে বলতে উঠে সৌগতবাবুর সামনেই মুকুলবাবু বলেন, “১৯৯৮ সালে যখন তৃণমূল গড়া হয়েছিল, তখন যাঁরা গড়েছিলেন, বলেছিলেন ঐতিহাসিক প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিপিএমের অপশাসনের অবসানের লক্ষ্যে দল গড়া হয়েছিল। দল গঠনের সময় অনেকেই ছিলেন না। এখন অনেক বোদ্ধাই দলে এসেছেন, যাঁরা আগে ছিলেন না!” মুকুলবাবুর আরও মন্তব্য, “আমরা অনেক লড়াই করে সরকারে এসেছি। এখন কে আগে এল, কে পরে এল, তা ভাবার প্রয়োজন নেই। সবাই মিলে আমরা একটা পরিবার।”
তৃণমূলের তরজার এই কাহিনি শুনে সিপিএমের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “আমাদের দল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের ওঁরা পদ দিয়েছেন, কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে মন্ত্রী করেছেন। এ সব ওঁদের দলে নতুন নয়। তবে নতুন-পুরনোর মারপিট যদি রাস্তায় নেমে আসে, তা হলে সকলের বিপদ!” |