বারাসত-কাণ্ডের তদন্তে নেমে নানা প্রশ্নের জটে ঘুরপাক খাচ্ছে সিআইডি। মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে যেমন ধন্দ রয়েছে গোয়েন্দাদের, তেমনই তাঁকে কী ভাবে খুন করা হয়েছিল, তা নিয়েও এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁরা।
এই ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। রবিবার, অর্থাৎ ঘটনার পরদিনই রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বিষয়টিকে ‘পারিবারিক বিবাদ’ বলে আখ্যা দেওয়ায় এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। যার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, “প্রয়োজনে দিল্লির মতো এ রাজ্যেও প্রতিবাদ হবে।” সরকার পক্ষের মন্তব্যের পরে মঙ্গলবার নিহতের ছেলে বলেন, “ধর্ষণের ঘটনাকে অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা চাই, অপরাধীরা ধরা পড়ুক।”
ঘটনার পর থেকে জেলা পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও সোমবার বিকেলে তদন্তভার নেয় সিআইডি। মঙ্গলবার সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপার রাজেশ যাদবের নেতৃত্বে একটি দল বারাসতে যায়। সোনাখড়কি গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি এই ঘটনায় এক মাত্র ধৃত ইশা মোড়লকে জেরা করেন গোয়েন্দারা। তবে এ দিন রাত পর্যন্ত তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলে সিআইডি-র দাবি। সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সিআইডি সূত্রের খবর, শ্বাসরোধ করে ওই মহিলাকে খুন করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। শ্বাসরোধ করার পর ওই মহিলাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল বলে পুলিশের অনুমান। প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত কয়েকটি প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, খুন করার পর মহিলার দেহ দুষ্কৃতীরা কিছু দূর টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তাঁকে কি ধর্ষণ করা হয়েছিল? ঘটনার তিন দিন পরেও এ নিয়ে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি পুলিশ। ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ময়নাতদন্তের সময় ধর্ষণ সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। এ দিন ধৃত ইশা মোড়লের বীর্যের নমুনা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। নিহত মহিলার দেহ থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা হবে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই ইটভাটার কিছু শ্রমিককে জেরা করেছে পুলিশ। ইটভাটার ‘লগ-বুক’ থেকে শ্রমিকদের আসা-যাওয়া নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ জেনেছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টা নাগাদ ইটভাটা থেকে বেরিয়ে যান নিহতের স্বামী। নিহতের পরিবারের সদস্যদের জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, নিহতের স্বামী সন্ধ্যা সওয়া ছ’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখেন, স্ত্রী ফেরেননি। তখন তিনি স্ত্রীকে খুঁজতে যান। এর মিনিট পনেরো পরেই রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে ঘটনার খবর দেন।
তদন্তকারীদের প্রশ্ন, ইটভাটা থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে বাড়িতে পৌঁছতে এত সময় লাগল কেন? তা হলে ওই সময়ে কি অন্য কোথাও ছিলেন তিনি? এক পুলিশকর্তা জানান, এ সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ধন্দ রয়েছে, নিহতের স্বামীর শারীরিক অবস্থা নিয়েও। ঘটনার পর ওই ব্যক্তিকে আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, তাঁকে অ্যাসিড খাওয়ানো হয়েছে। অ্যাসিডে তাঁর মুখের ভিতর থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছে। যদিও সিআইডি-র একটি সূত্রের দাবি, চিকিৎসকেরা যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে মুখের বাইরে কোনও অ্যাসিডের ক্ষত নেই। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, জোর করে অ্যাসিড খাওয়ানোর ঘটনা ঘটলে মুখের বাইরে ক্ষত হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বোতল থেকে ছিটকে পড়ে। এ ক্ষেত্রে তা হল না কেন? এ ব্যাপারে ধন্দে রয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, বাইরে থেকে মনে হয়েছে, মুখের ভিতর থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছে। তবে এন্ডোস্কোপি না করা পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে হাসপাতালের মেডিক্যাল বোর্ডের এক সদস্য বলেন, “জোর করে অ্যাসিড খাওয়ানো হয়েছে কি না তা জানার জন্য টক্সিকোলজি পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া জরুরি।” |