ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট |
শেয়ার বাজারের প্রবেশপথ |
শেয়ার কিনতে গেলে প্রথমে ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতেই হবে আপনাকে। অনেক সময়ে তা লাগবে
মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কিনতেও। তাই সামান্য কিছু ব্যতিক্রমকে সরিয়ে রাখলে এই অ্যাকাউন্টই
কিন্তু শেয়ার বাজারে পা রাখার প্রাথমিক শর্ত। লগ্নির প্রবেশপথ। হদিস দিলেন প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী |
আড্ডা, আলোচনায় টাকা জমানোর কথা উঠলে, ডি-ম্যাটের ‘নাম’ গোড়াতেই করে ফেলি আমরা। কেউ শেয়ার কিনতে (অনেক সময়ে মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করতে) চাইলে, পরামর্শ দিই শুরুতেই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে নেওয়ার। অথচ কেন এই অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছিল বা কী ভাবে তা খুলতে হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই আমাদের অনেকেরই। তাই আজ এখানে এ নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা।
|
ডি-ম্যাট মানে? |
• পুরো নাম ডিমেটিরিয়ালাইজেশন অফ শেয়ার্স। সহজ কথায়, বৈদ্যুতিন প্রক্রিয়ায় শেয়ার রাখার ব্যবস্থা। আগে শেয়ার সার্টিফিকেট মানে বোঝাত সত্যি সত্যিই শেয়ারের কাগজ। কিন্তু এখন সেই কাগজের বদলে আপনার নামের সমস্ত শেয়ার গচ্ছিত থাকে ওই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টে, অনলাইনে। সে জন্য ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকলে তবেই কাগজহীন বাজারে শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারবেন আপনি।
• ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে থেকে বাধ্যতামূলক হয় এই ব্যবস্থা। বৈদ্যুতিন ব্যবস্থায় শেয়ার গচ্ছিত রাখতে তৈরি করা হয় দু’টি সংস্থা—
(১) ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ ডিপোজিটরি লিমিটেড (এনএসডিএল)
(২) সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি সার্ভিসেস লিমিটেড (সিডিএসএল)
• এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল শেয়ার লেনদেনে স্বচ্ছতা আনা এবং তা হস্তান্তর সরল ও সমস্যামুক্ত করা। আপনার খোলা ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই নজর রাখা সম্ভব হবে সেখানে হওয়া যাবতীয় বেচা-কেনার উপর।
|
সে দিন বনাম এ দিন |
আগে কেউ শেয়ার কিনলে, সত্যিকারের কাগজের সার্টিফিকেট হাতে পেতেন। তার পর ওই শেয়ার নিজের নামে করার জন্য নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করতে হত তাঁকে। ডাক মারফত পাঠাতে হত সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। লেনদেনের অঙ্কের ভিত্তিতে ফর্মের উপর লাগাতে হত স্ট্যাম্প ডিউটি। শুধু তা-ই নয়, এত সবের পরেও ওই হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অনেক সময়ে সমস্যায় পড়তেন লগ্নিকারীরা। কারণ, ফর্মের সইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার রেকর্ডে থাকা স্বাক্ষর প্রায়শই মিলত না। ফলে আটকে যেত হস্তান্তর। ডাকে পাঠানো শেয়ার সার্টিফিকেটের হদিস না-পাওয়ার ঘটনাও ঘটত আখছার। এ ধরনের অজস্র সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়েই বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শেয়ার লেনদেনের হাত ধরা।
|
অ্যাকাউন্ট খোলার খুঁটিনাটি |
কেন বা কখন ডি-ম্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন, তা নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম আমরা। এ বার জেনে নিই কাদের কাছে কী ভাবে এই অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। মনে রাখবেন, আপনি শুধু নিজের নামে এই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। সেই সঙ্গে অবশ্য সর্বোচ্চ আরও দু’জনের নাম (সেকেন্ড ও থার্ড হোল্ডার) যোগ করতে পারেন সেখানে।
|
খুলবেন কার কাছে? |
ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে এনএসডিএল অথবা সিডিএসএলের খাতায় নথিভুক্ত যে কোনও ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট-এর কাছে। মূলত এরা হল— ব্যাঙ্ক, ব্রোকারেজ সংস্থা এবং এনবিএফসি (ব্যাঙ্ক নয়, এমন আর্থিক সংস্থা)।
|
যোগ্য কারা? |
ব্যক্তিগত ভাবে ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন দেশের যে কোনও সাধারণ নাগরিক। খুলতে পারেন অনাবাসী ভারতীয়রাও। দরজা খোলা অবিভক্ত হিন্দু পরিবার (এইচইউএফ)-এর কর্তা, কোনও কর্পোরেট সংস্থা, পার্টনারশিপ কিংবা প্রপ্রাইটারি সংস্থার মালিক কিংবা অংশীদারের (পার্টনার) জন্যও।
|
আঠেরোর আগে |
অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে নাবালকের নামেও। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের বয়স আঠেরোর কম হওয়ায় জানাতে হবে অভিভাবকের নাম, ঠিকানা-সহ ফর্মে উল্লিখিত যাবতীয় তথ্য। ওই অ্যাকাউন্টে শেয়ার লেনদেনের জন্য মেনে চলতে হবে সংশ্লিষ্ট সমস্ত আইনও।
|
একের বেশি চাইলে? |
হ্যাঁ, এক জন লগ্নিকারী নিজের নামে একাধিক অ্যকাউন্ট খুলতেই পারেন। তবে দু’টি শর্ত আছে—
(১) কেউ ২০টির বেশি অ্যকাউন্ট খুলতে পারবেন না।
(২) কোনও একটি ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্টের কাছে খোলা যাবে না পাঁচটির বেশি ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট।
|
|
আগে পরিচয় দিন |
ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে নো ইওর ক্লায়েন্ট বা কেওয়াইসি বিধি মেনে ফর্ম পূরণ করতে হবে আপনাকে। তার জন্য মানতে হবে কেওয়াইসি রেগুলেটরি অথরিটি (কেআরএ)-র বিধি। শেয়ার বাজারের ভাষায় একে বলে কেআরএ করা। তবে যতগুলি অ্যাকাউন্টই খুলুন না কেন, কেআরএ করতে হবে মাত্র এক বারই। এ বিষয়ে ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট-ই সাহায্য করবে আপনাকে।
|
তৈরি রাখুন নথি |
ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খেলার পদ্ধতি এমন কিছু জটিল নয়। কিন্তু এ জন্য বেশ কিছু নথি-পত্র জমা দিতে হবে আপনাকে। তাই আগে থেকেই পুরোদস্তুর তালিকা বানিয়ে সে সব নথি গুছিয়ে রাখুন। এই তালিকায় রয়েছে—
• সচিত্র পরিচয়পত্র।
• ঠিকানার প্রমাণপত্র। যদি আপনার স্থায়ী (পার্মানেন্ট) এবং বর্তমান (প্রেজেন্ট) ঠিকানা আলাদা হয়, তা হলে দু’য়েরই প্রমাণপত্র জমা দিন। আবার শেয়ার লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য ডাকে বা ক্যুরিয়ারে পাঠানোর জন্য পৃথক কোনও ঠিকানা (করেস্পনডেন্স অ্যাড্রেস) দিলে, দিতে হবে তার প্রমাণপত্রও।
• স্থায়ী (পার্মানেন্ট) ও বর্তমান (প্রেজেন্ট) ঠিকানা একই হলে, পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা আধার কার্ডের ফোটো-কপি দিলেই পরিচয় ও ঠিকানা, দু’য়েরই প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু দু’টি বিষয়ের জন্য আলাদা ভাবে প্রমাণপত্র দাখিল করতে হলে কাজে আসতে পারে রেশন কার্ড, ব্যাঙ্কের পাসবই, স্ট্যাম্প ও কর্তৃপক্ষের সই-সহ ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট (৬ মাসের), বাড়ি ভাড়া বা লিজ এগ্রিমেন্ট, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সার্টিফিকেট। সমস্ত ক্ষেত্রেই মূল (অরিজিনাল) কপি ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মূল কপির সঙ্গে মিলিয়ে ফোটোকপি ‘সার্টিফাই’ করবে তারাই।
• প্যান কার্ডের ফোটো কপি।
• সেকেন্ড বা থার্ড হোল্ডার থাকলে, তাঁদেরও প্যান কার্ড। দিতে হবে তাঁদের পরিচয় এবং ঠিকানার প্রমাণ সংক্রান্ত নথিও।
• নিজের এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অ্যাকাউন্ট-হোল্ডারের (থাকলে) ছবি।
|
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ |
মনে রাখবেন, ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আগে থেকেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি। ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে দিতে হবে সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ বিবরণ। উল্লেখ করতে হবে চেকের ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেকটার রেকগনিশন (এমআইসিআর) নম্বর। ওই নম্বরের প্রমাণ হিসেবে একটি বাতিল লেখা চেক আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়াই প্রচলিত রীতি।
ব্যাঙ্কের ঠিকানা ইত্যাদিও উল্লেখ করতে হবে আবেদনপত্রে। এমআইসিআর থাকলে, শেয়ারের ডিভিডেন্ড সরাসরি জমা পড়বে আবেদনে উল্লেখ থাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। অন্যরা ডিভিডেন্ডের চেক পাবেন বাড়ির ঠিকানায়। ডাক কিংবা ক্যুরিয়ারে। তবে সে ক্ষেত্রেও চেকের উপর উল্লেখ করা থাকবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর। ওই চেক ভাঙাতে হবে সেখানেই।
|
জানাতে হবে রোজগারও |
অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আয়ের বিবরণ দিতে তৈরি থাকুন। উল্লেখ করতে হবে আয়ের উৎসও। মনে রাখবেন, আয়ের সঙ্গে শেয়ারে লগ্নি করা অঙ্কের সামঞ্জস্য না-থাকলে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে তা জানাতে বাধ্য ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট। তাই পরে আয় বা তার উৎসের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও জানিয়ে রাখতে হবে ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট-কে।
|
নমিনি করতে ভুলবেন না |
আবেদনপত্রে নমিনির নাম উল্লেখ করতে পারেন। এবং তা করাই উচিত। কারণ, কোনও কারণে লগ্নিকারীর মৃত্যু হলে, তাঁর শেয়ারের মালিকানা সহজেই পাবেন নমিনি। নইলে উত্তরাধিকারী ‘খুঁজতে’ যেতে হবে জটিল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে।
|
সঙ্গে থাক চুক্তির কপি |
অ্যাকাউন্ট খোলার সময়েই ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট ও অ্যাকাউন্ট-হোল্ডারের মধ্যে চুক্তি সই হওয়ার কথা। ওই চুক্তিতে উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য উল্লেখ করা থাকে। এর জন্য স্ট্যাম্প ডিউটির খরচ বইতে হবে লগ্নিকারীকেই। এই চুক্তির কপি অবশ্যই নিজের কাছে রাখতে ভুলবেন না।
|
খরচাপাতি |
এমনিতে অ্যাকাউন্ট খোলা বা বন্ধের কোনও খরচ নেই। তবে অ্যাকাউন্ট চালু রাখা ও বিভিন্ন পরিষেবা বাবদ বছরে একটি চার্জ নেয় ডিপোজিটরি পার্টিসিপ্যান্ট। এই চার্জের কোনও নির্দিষ্ট অঙ্ক নেই। এক-এক ব্যাঙ্ক বা ব্রোকারেজ সংস্থায় তা এক-এক রকম। |
|