চিনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। সূচনা করেছিলেন নয়া এক যূগের। সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করে চিনে কায়েম করেছিলেন কমিউনিস্ট শাসনের সুদৃঢ় ভিত্তিপ্রস্তর। জন্ম দিয়েছিলেন গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের। দেশের কৃষি, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, এক কথায় গোটা অর্থনীতিটাকেই সামাজিক মালিকানার আওতায় এনেছিলেন তিনি। কৃষি প্রধান চিনে প্রয়োগ করেছিলেন মার্ক্সবাদের তত্ত্ব। ১৯৪৯ সালে গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের জন্মের কাল থেকে আমৃত্যু একার দায়িত্বে পরিচালনা করে গিয়েছেন গোটা দেশটাকে। পাশে পাশেই সামলেছেন দলীয় প্রধান হওয়ার সমস্ত দায়িত্বও। তিনি আর কেউ নন। তিনিই ‘চেয়ারম্যান মাও’, মাও জে দং। বুধবারই ছিল তাঁর ১১৯তম জন্মদিন। কিন্তু কী ভাবে মাও-এর হাতে গড়া চিন পালন করল তাঁর জন্মদিনটি?
ছবিটা ছিল অনেকটা এ রকম। এক দিকে চলছিল মাও জে দংয়ের জন্মদিন পালনের উৎসব। হুনান প্রদেশের এক অনুষ্ঠানে জমায়েত হয়েছিলেন বুড়ো, আধ-বুড়ো, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। চলছিল ‘চেয়ারম্যান মাও’য়ের স্মৃতি রোমন্থন। পরিবেশন করা হচ্ছিল একের পর এক গণ সঙ্গীত। মাও-এর যূগেই বেড়ে ওঠা এই সব ৬০ পেরোনো মানুষদের কাছ থেকে এইটাইতো আশা করা যায়। মাও ও তাঁর তত্ত্বের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন যে তাঁরা, থাকবেনও।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের উপর মাও এর কী প্রভাব? উত্তর মিলল বুধবারই। যখন হুনান প্রদেশে চলছিল মাওকে সন্মান জানানোর পালা তখনই দেশের অন্য প্রান্তে চলছিল মাও এর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে তাঁর তত্ত্বকে পদদলিত করার অদম্য চেষ্টা। অর্থনৈতিক সংস্কারের স্রোতে ভাসমান বর্তমান প্রজন্ম সরাসরি পথে নেমে বিরোধিতা করছিলেন মাও-এর চরমপন্থী মতাদর্শের। জন্মদিনের দিনটায় তাঁদের কাছ থেকে বিন্দু মাত্রও শ্রদ্ধা পেলেন না মাও। বরং পেলেন তিরস্কার। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও দেশকে এক লাফে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কড়া নীতিগুলোর জন্য এ দিন তাঁকে যতপরনাস্তি দুষলেন বর্তমান প্রজন্ম।
চিনের ভবিষ্যৎ নিধার্রণে মাওয়ের কী ভূমিকা, এই নিয়ে তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছে বহু দিন ধরেই। কেউ বলেন হ্যাঁ, মাওয়ের মতাদর্শ তরাণ্বিত করেছে চিনের উন্নয়ন। কেউ আবার বলে না, তাঁর চরমপন্থী সমাজতন্ত্রের নীতি চিনকে বিশ্ব শক্তি হওয়ার লড়াইয়ে পিছিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। গত মাসের ঘটনা, বেজিংয়ে জাপান-বিরোধী এক মিছিলে মাওয়ের সমালোচনা করায় এক বৃদ্ধকে থাপ্পড় মেরেছিলেন এক অধ্যাপক। অন্য দিকে, গত মাসেই মাওয়ের ছবি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে সেই ছবি ইন্টারনেটে পোস্ট করেছিলেন কিছু যুবক। একটা সময় ছিল যখন চিনের মানুষের কাছে মাওয়ের মতাদর্শ ছিল বেদবাক্য স্বরূপ। তাঁর প্রতি অবমাননার এ রকম ঘটনাকে ধরা হত গুরু পাপ হিসেবে। কিন্তু এখন আর সে দিন কই। ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন দেং জিয়াওপিং। শুরু হয় আমূল সংস্কার সাধনের পালা। সূচনা হয় নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট শাসনের অধ্যায়।
গত মাসেই চিনে সম্পন্ন হল ক্ষমতা হস্তান্তর পালা। শি জিনপিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বো জিলাই। হার হয়েছিল বো-এর। নির্বাচনী প্রচারে মাওয়ের মতাদর্শকেই ফিরিয়ে আনার কথা বার বার বলেছিলেন তিনি। তাই বোধ হয় হার হয় তাঁর। ক্ষমতায় আসেন শি জিনপিং। আসন লাভের পরেই তিনি অঙ্গীকার করেন চিনের অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে সংস্কারের পথেই অটল থাকবেন তিনি। সমূলে উৎপাটন করবেন মাওয়ের মতাদর্শ অনুসরণ করার সমস্ত সম্ভাবনাকেই।
তিয়েনানমেন স্কোয়ারে আজও গেলে দেখা যাবে সেখানে ঝুলছে মাও জে দংয়ের মস্ত এক ছবি। কিন্তু বুধবার যে ভাবে চিনে তাঁর জন্মদিন পালন হল, তাতে প্রশ্ন জাগে আদউ চিনের মানুষ মনে রেখেছেন তো তাঁদের চেয়ারম্যানকে? |