সরকার বদলের পরে বাংলার ভাবমূর্তি ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ‘রিসারজেন্ট বেঙ্গল’ (পুনরুজ্জীবিত বাংলা) প্রকল্প শুরুতেই কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে! মুখ্যমন্ত্রী যাঁর উপরে এর ভার সঁপেছিলেন, সেই স্যাম পিত্রোদার সঙ্গে গত প্রায় এক বছর মহাকরণের তেমন যোগাযোগ নেই! এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর গড়ে দেওয়া সংশ্লিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির দুই আইএএস অফিসারও বদলি হয়ে চলে গিয়েছেন অন্যত্র।
পরিবর্তনের আগে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। সেটা ছিল সিঙ্গুর-পরবর্তী অধ্যায়, ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ যখন প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। তাঁর ‘ব্র্যান্ড বেঙ্গল’-এর ভাবনাকে রূপ দিতে
|
স্যাম পিত্রোদা |
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কোটি টাকা মূল্যের রিপোর্ট পেশ করেছিল ২০১০-এর ডিসেম্বরে। কিন্তু তত দিনে বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। ভোটের পরে বামফ্রন্ট আর ক্ষমতায় ফেরেনি। নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতাও সেই রিপোর্টকে গুরুত্ব দেননি। বরং নতুন ভাবনা দিয়ে বিষয়টিকে সাজানোর পরিকল্পনা করেন তিনি।
আর সেই দায়িত্বই মমতা তুলে দেন স্যাম পিত্রোদার হাতে, কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মন্ত্রকের কাজের পরামর্শদাতা হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে দায়িত্ব নেন পিত্রোদা। রাজ্যের তথ্য-প্রযুক্তি এবং বাংলার পুনরুজ্জীবন নিয়ে পিত্রোদার পরামর্শ চান মুখ্যমন্ত্রী। স্থির হয়, কোন পথে রাজ্যের পুনরুজ্জীবন সম্ভব, এবং কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের নতুন চেহারার ছবি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা যাবে, সে ব্যাপারে সরকারকে পরমার্শ দেবেন পিত্রোদা।
সরকারের এক মুখপাত্র জানান, গত বছরের অগস্টে পিত্রোদা তাঁর ‘ভাবনা’-র কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, মমতার ‘পরিবর্তনের’ ডাককেই তিনি পুনরুজ্জীবনের প্রধান হাতিয়ার করতে চান। তার পরে অক্টোবর ও নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের অফিসারদের সঙ্গে তিনি ভিডিও কনফারেন্স করেন। পিত্রোদার ভাবনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজ্যের দুই আইএএস অফিসার সুব্রত গুপ্ত ও শান্তনু বসুকে নিয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গড়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কমিটির সঙ্গে পিত্রোদার কথা হয়। কমিটির এক সদস্য দিল্লিতে গিয়ে যোজনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পিত্রোদার নির্দেশিত পথে এগোতে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমে অফিস বানানোর জন্য নোট তৈরি হয়। ঠিক হয়, পুরো কর্মকাণ্ড দিল্লি থেকে পিত্রোদা নিয়ন্ত্রণ করবেন। আর কলকাতার অফিসে বসে, রাজ্যের অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করবে ‘টিম পিত্রোদা।’
তাঁদের ভাবনাটা কী?
পিত্রোদা চেয়েছিলেন, একেবারে সকালের চায়ের কাপ থেকে শুরু করতে। সেই লক্ষ্যে ছাপা হবে ঝকঝকে মলাটের নজরকাড়া একটা বই কফি টেব্ল বুক অন বেঙ্গল। তাতে রাজ্যের প্রাক্-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাস বিবৃত থাকবে। সঙ্গে থাকবে বার্তা পরিবর্তনের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। পিত্রোদার ইচ্ছে ছিল, বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিক এবং ভিন দেশে ছড়িয়ে থাকা এক হাজার বাছাই করা বাঙালির প্রাতরাশের টেবিলে পৌঁছে যাক পুনরুজ্জীবিত বাংলার এই বিবরণ। পাশাপাশি পরিকল্পনা ছিল একটা ওয়েবসাইট তৈরির। যার মাধ্যমে তামাম বিশ্ব দেখতে পারবে, অবিরত কী ঘটে চলেছে এ রাজ্যে। কেউ চাইলে সেখানে পরামর্শ দিতে পারবেন। একদা উত্তর কলকাতার হাতিবাগান ছিল থিয়েটারের পীঠস্থান। শিল্প-সংস্কৃতির সেই গৌরব পুনরুদ্ধারে কলকাতায় ‘থিয়েটার ডিস্ট্রিক্ট’ তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন পিত্রোদা। বলেছিলেন কলকাতা-হলদিয়া-শান্তিনিকেতনকে বাংলার ‘থিম’ হিসেবে তুলে ধরার কথা। একটি ‘নলেজ সিটি’ গড়ার
প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
তার পরে বছর গড়িয়ে গিয়েছে।
পুনরুজ্জীবিত বাংলা গড়ার উদ্যোগে এখন ভাটার টান স্পষ্ট। সরকারি সূত্রের খবর: এই কাজের জন্য কোনও অফিস এখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি। যে দুই আইএএস-কে নিয়ে কমিটি গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁদের এক জন হাওড়ার জেলাশাসক হয়ে চলে গিয়েছেন, অন্য জন কেন্দ্রে বদলি হয়েছেন। বাংলা পুনরুজ্জীবনের ফাইলে ধুলো জমছে। পরিস্থিতি দেখে-শুনে পিত্রোদাও বিশেষ আর এগোননি। তবে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি একটি চিঠি দিয়েছেন। তাতে পিত্রোদার বক্তব্য: নিজের কাজগুলো তিনি সেরে ফেলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর আবার প্রয়োজন হলেও তিনি আছেন। “হাতে অবশ্য এখনও প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় আছে।” সহাস্য মন্তব্য প্রশাসনের এক শীর্ষ অফিসারের। |