কোনটা বেশি আজগুবি? সচিন তেন্ডুলকরের তেইশ বছর ধরে ক্রিকেট খেলে যাওয়া? না কি আজকের দিনটা এসে উপস্থিত হওয়া, যে দিন ভারতীয় বোর্ডের মঞ্চে প্রকাশ্য বলে দেওয়া হবেসচিন নিয়ে কোনও প্রশ্ন বরদাস্ত করা হবে না?
ক্রিকেটমহলের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে পরেরটা। কেউ ভাবতেই পারছেন না সত্যি এমন হতে পারে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সাংবাদিক সম্মেলন চিন্নাস্বামীতে শুরু হওয়ার আগে বোর্ডের মুখপাত্র যে এমন পূর্বশর্ত দিয়ে দিতে পারেন, ক্যাপ্টেনকে যে প্রশ্ন করার, সব কালকের ম্যাচের ওপর। তার বাইরে নয়। বলা হল, শুরুতে ধোনি কিছু বলবেন তেন্ডুলকর নিয়ে। কিন্তু ওটাই প্রথম। ওটাই শেষ। আর কিছু নয়। |
পুরোনো দিন হলে ক্রিকেট প্রেস অবশ্যই উত্তেজিত প্রতিবাদ করত, মানেটা কী? এত বড় একটা ঘটনা কাল ঘটে গিয়েছে। টিম ইন্ডিয়া থেকে সরকারি ভাবে কেউ কিছু বলেনি। যুবরাজ সিংহ আনন্দবাজারে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। বিরাট কোহলি আর সুরেশ রায়না টুইট করেছেন। কিন্তু যে অবসর নিয়ে এত সব কথাবার্তা, এত চাঞ্চল্য আর বিতর্ক, তা নিয়ে ক্যাপ্টেনের প্রেস কনফারেন্সেও প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়া যাবে না! সমস্যা হল, এই ভারতীয় ক্রিকেট প্রেস ধোনির টিম ইন্ডিয়ার মতোই শত ভাগে বিভক্ত। তা ছাড়া কেউ এতটা জঙ্গি হতে রাজি নয় যাতে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ক্ষিপ্ত হয়ে যাবেন!
ধোনি প্রতিবাদহীন শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য, “ওয়ান ডে ফর্ম্যাটে সচিন অবিশ্বাস্য। এটা খুব দুঃখের যে, রঙিন পোশাকে ওর ৫০তম সেঞ্চুরি ঘটবে না। খুব দুঃখের যে, ওর শততম হাফসেঞ্চুরি হবে না ওয়ান ডে-তে। সচিন আমাদের কাছে ক্রিকেট-উৎসাহের প্রতীক। আমরা ওর কাছে অনেক শিখেছি। যে ভাবে ও প্রত্যেকটা ম্যাচের জন্য তৈরি হত, শুধু সেটাই যেন অদৃশ্য এক শিক্ষায়তন। সচিনের কাছে আর শিখেছি মহাসাফল্যেও কী ভাবে মাথা ঠিক রাখতে হয়। কী ভাবে সাফল্যকে হজম করা উচিত। ওয়ান ডে ম্যাচে যে ভাবে ও হিসেব করত কী ভাবে কোন বোলারকে মারব! কখন কী ভাবব? সচিনকে আমরা ভীষণ মিস করব! তবে ও অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটে থাকছে।” বোর্ড মুখপাত্র তামিলনাড়ুর ড. বাবা হাত নেড়ে বলে দিলেন, ব্যস সচিন-অধ্যায় শেষ। এ বার বড়দিনের ভারত-পাক টি-টোয়েন্টি। |
তবু প্রথম প্রশ্ন হল সচিনের ওপর। তাঁকে বাইরে রেখে কী ভাবে ধোনি ২০১৫ বিশ্বকাপের দল তৈরি করবেন? বোর্ড মুখপাত্র তীব্র আপত্তির সুরে চোখ নাচালেন। ধোনি অবশ্য ততক্ষণে উত্তর দিয়ে দিয়েছেন, “এই যে এতক্ষণ বললাম। সচিন যা যা হাতে ধরে শিখিয়েছে তাতে এ বার তরুণদের রপ্ত হতে হবে।” এ বার আনন্দবাজারের প্রতিনিধি দুটো প্রশ্ন করলেন।
১) সচিন সম্পর্কে এত ভাল ভাল কথা বললেন। বললেন, আহা ও থাকলে কত ভাল হত। তা আপনি ক্যাপ্টেন হিসেবে কেন ওঁকে ওয়ান ডে অবসরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলছেন না? বলুন না, সামনের দুটো ওয়ান ডে সিরিজ অন্তত খেলে দিতে।
২) মুম্বই টি-টোয়েন্টিতে শেষ বলে হারার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কী ভাবে টিমকে নতুন করে গড়ছেন এত তাড়াতাড়ি? তা-ও সামনে যেখানে পাকিস্তান। যে ম্যাচ নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচের বাইরেও এত সব অঙ্ক?
সচিনের নামটা করামাত্র বোর্ড মুখপাত্র হাত দেখিয়ে বললেন, এটা কী হল? ধোনি ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, “টি-টোয়েন্টি ম্যাচের শেষ বলে হার নিয়ে এখন অতীতের শেষ বলে হারের মতো তোলপাড় হওয়ার কিছু নেই। এ সব ম্যাচের চরিত্রই তাই। অর্ধেক সময়ই শেষ ওভারে গিয়ে ঠিক হয় কারা জিতবে। কাজেই মুম্বই হারটা সমস্যা নয়। দুটো টিমই মোটামুটি একে অপরের সমকক্ষ। ভাল লড়াই হবে।”
এ বার বোর্ডের মুখপাত্র পরের প্রশ্নকর্তাকে ডাকবেন বলে ঠিক করেছেন। আনন্দবাজারের সাংবাদিক বিস্মিত ভাবে ভারত অধিনায়ককে বললেন, আপনি তো প্রথম প্রশ্নের জবাবটাই দিলেন না। |
ধোনির এ বার মুখচোখ গম্ভীর। “অবসর ওর নিজের সিদ্ধান্ত। তাকে আমি সম্মান করতে চাই।” তার মানে হল, অবসর ফিরিয়ে নিতে বলব না। অবশ্য এমনিতেও বলার প্রশ্ন নেই। সচিনের ভিআরএস স্কিমে তো ধোনিই অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক।
বিস্ময়ের হল, সচিন নিয়ে বোর্ডের মনোভাবের রেশ কী প্রতিক্রিয়া নিতে পারে তা নিয়ে বোর্ডকর্তাদেরই এত কম্পিত থাকা। বোর্ডের মুখপাত্র অবশ্যই ধোনির কথা শুনে সাংবাদিকদের সচিন-সংক্রান্ত প্রশ্নের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। এটা খোদ বড়কর্তার নির্দেশ ছাড়া হতে পারে না। সোমবার বিকেলে ভারতীয় দলের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলছিলেন, শ্রীনিবাসন কিন্তু অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে গিয়েছেন। উনি বুঝতে পারছেন না এখনও টিমে সচিনের সমর্থন কী রকম রয়েছে। শুধু আজকের সাংবাদিক সম্মেলনের খবরটা পৌঁছলেই টিমে যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
এ দিন ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে যখন শোয়েব-সানিয়া এসে একই সময় প্রাতঃরাশে ব্যস্ত ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন, সবার মনোযোগ সে দিকে। এক সাপোর্ট স্টাফ সেই ভিড় থেকে বার হয়ে এলেন। “কী শুনছি? মাস্টারকে নাকি ইচ্ছাকৃত বাদ দেওয়া হয়েছে?” সচিনকে ভারতীয় ড্রেসিংরুম এই দুটো নামেই ডাকে। মাস্টার অথবা পাজি। এ দিন অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটের বহিরঙ্গের চেহারা দেখে মনে হল অন্তত এই সপ্তাহের জন্য তাঁকে ডাকাই যেতে পারে, ক্রুশবিদ্ধ যিশু! |
পাঁচ বছর পর ভারত সফরে এসে পাকিস্তানের চুটিয়ে উপভোগ করার মতো পরিস্থিতি। টিম ইন্ডিয়া চিরকালীন শত্রুদের বিরুদ্ধে মর্যাদার লড়াই জিততে চাইবে কী। নিজেরা তো নিজেদেরই খেলছে। ভারত বনাম পাকিস্তান পরের ম্যাচ। আগে ভারত বনাম ভারত।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় টিম ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠা করার পর এমন সমস্যাসঙ্কুল সময় কখনও এসেছে বলে মনে হয় না, যেখানে টিমে গোপন ব্যালট হলে অধিনায়ক ৪ ভোটও পাবেন না। যেখানে বেশির ভাগই টিম ভুলে নিজের কথা ভাবছে। ইন্ডিয়া গেটের সামনে যে বিক্ষোভের ছবি ভারত টিভির পর্দায় গত ক’দিন দেখছে, ধরে নিন সেটাই এখানে অন্তরমহলে ঘটছে টিমের পরিচালন সমিতির বিপক্ষে। শুধু একটা প্রকাশ্য। আর একটা গোপন স্ক্যান করলে তবেই টের পাওয়া সম্ভব।
ষাট বা সত্তরের দশক হলে নিশ্চিত লিখে দেওয়া যেত, সিরিজে পাকিস্তান ফেভারিট। সেই সময় টিম স্পিরিট একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। লোকে অধিনায়কের জন্য খেলত। অধিনায়ককে বেশি ভালবাসলে বেশি মন দিত। এখন সে সব দিন নেই। স্পিরিট বা নেতার আচরণ বিচার্য নয়। এখন প্লেয়ার নিজেরটা দেখে। নিজের জন্য খেলে। নিজেরটা বুঝে নেয়। তাই ভারতীয় পেশাদাররা প্রাণপণ লড়াই করবে এতে সন্দেহ নেই। সন্দেহ একমাত্র আছে আপাতত তাদের টিম ইন্ডিয়া না বলে স্রেফ ইন্ডিয়ান ইলেভেন বলাই উচিত কি না!
|