|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ফাঁসি বড় কথা নয়, দরকার আইনের শাসন |
প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশিকা মেনে পুলিশ, সরকারি চিকিৎসক এবং বিচারব্যবস্থা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন
করবে, সে জন্য নির্দিষ্ট
সময়সীমা বেঁধে দেওয়া জরুরি। আর, ‘মেয়েটি নিশ্চয় সম্মত ছিল, এখন
বিগড়ে বসেছে’ এমন মনোভাব নিয়ে
সন্ধান বা বিচার শুরু করলে সত্যপ্রতিষ্ঠা কখনওই সম্ভব নয়।
শাশ্বতী ঘোষ |
রাজধানী আর তার আশপাশের বহু বহু মানুষ, ইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, তাদের অভিভাবকরাও বাসের মধ্যে ২৩ বছরের ছাত্রীটির গণধর্ষণের প্রতিবাদে পথে শামিল হয়েছেন, ঠান্ডায় জলকামানে ভিজেছেন, শান্তিপ্রিয় সহপ্রতিবাদীটি পুলিশের লাঠি খেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে লাঠিটা আটকে ধরেছেন। মুখময় অ্যাসিড ছোড়ার দাগ নিয়ে এক প্রতিবাদিনী এসেছেন, এসেছেন বিচার না পাওয়া ধর্ষিতা নাবালিকার দরিদ্র অসহায় পিতা। ঘটনার নৃশংসতা এই স্বতঃর্স্ফূত প্রতিবাদের উৎস নিশ্চয়ই, কিন্তু শুধু কি তাই? তাঁরা বলেছেন এই ঘটনা তাঁদের নিজেদের বা কোনও প্রিয়জনের হতে পারে, কোনও সহপাঠিনীকে বাঁচাতে গিয়ে সহপাঠীর প্রাণ সংশয় হতে পারে, আর ভি আই পি-দের ছেড়ে পুলিশ বা সরকার সাধারণ মানুষের জন্য কোনও প্রতিকার করবে এ আস্থা কম এই বিক্ষোভ তারই প্রকাশ।
এই দেশের প্রকাশ্য স্থানগুলিতে, যাকে আমরা ‘পাবলিক স্পেস’ বলি, সেখানে সহনাগরিক হিসাবে মেয়েদের অধিকার আজও স্বীকৃত নয়। রাতে বারে গিয়ে মদ খেয়ে আউট হওয়ার অধিকার তো তাঁদের নেই-ই, এমনকী নেই সন্ধের পর বাইরে কাজে, ইস্কুল বা কোচিং-এ যাবার, অসুস্থ স্বামী বা সন্তানের জন্য খাবার বা ওষুধ কিনে আনার, যাত্রাপালা বা জলসা দেখে ফেরার, পার্কে বসে গপ্পো করতে করতে বাদামভাজা খাওয়ার। যদি সেই অধিকার স্বীকৃত হত, তা হলে পাবলিক স্পেসে এত মেয়ে নিগ্রহের শিকার হতেন না। তাই মেয়েদের কাজে অংশ নেওয়া আর সমাজ সংস্কারের ইতিহাস নিয়ে বহু দিন ধরে গড়ে ওঠা মুম্বইতে মেয়েরা অনেক নিরাপদ বোধ করেন, যে নিরাপত্তা রাজধানী দিল্লি দিতে পারে না। কিন্তু শুধু দিল্লি নয়, ‘বাহির’-এর পরিসরে নিরাপত্তার অভাব প্রায় প্রতিটি মেয়েই জীবনের কোনও না কোনও মুহূর্তে অনুভব করেছেন। |
|
গভীরে একটাই দাবি: নিরাপত্তা। বিজয় চক, দিল্লি, ২২ ডিসেম্বর ২০১২। ছবি: পি টি আই |
নিরাপত্তার মানচিত্র |
পরিসংখ্যান বলছে, মেয়েরা ঘরের মধ্যে অনেক বেশি নিগ্রহের স্বীকার হন, কিন্তু মেয়েদের যৌননিগ্রহের জুজু দেখিয়ে ‘বাহির’টাকে অনেক বেশি দূরের করে রাখা হয়েছে। বাস্তবেও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, প্রায় ৮০% ধর্ষণের ঘটনা ঘটে অন্তত একবার দেখা হয়েছে এমন মানুষের হাতে। শুধু ‘বাহির’টাই যে বিপজ্জনক, এই গপ্পকথায় পুষ্ট হয়ে আসল ঘটনার সামনে পড়লে মেয়েদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস টুকরো টুকরো হয়ে যায় আর তার জায়গা নেয় অসীম আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক আর অস্তিত্বের মিশ্রণে তৈরি হয় ‘ভাল’ জায়গা আর ‘খারাপ’ জায়গার ধারণা।
কিন্তু সেই ধারণা কোনও গপ্পকথা নয়। ২০০৬ সালে দিল্লি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি নারী সংগঠন যখন নিরাপদ দিল্লি ক্যাম্পেন শুরু করে, তারা সমীক্ষা করে দেখে ঠিক কোন কোন জায়গাগুলোতে মেয়েরা আতঙ্ক বা অস্বস্তি বোধ করেন এবং কেন। এই আতঙ্কের বোধ নির্ভর করে অনেকগুলি বিষয়ের উপর, কিন্তু সবচেয়ে বড় হল, সেখানে যথেষ্ট আলো আছে না নেই। তাই সুশীল শিন্ডে যখন বলেন আরও সরকারি বাস আর বাসে বেশি করে আলো দেওয়া হবে, তা ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন জাগায়: বাসস্টপগুলিতে নয় কেন?
মেয়েরা অন্ধকারকে ভয় পান, ভয় পান ফাঁকা জায়গাকে। তাই সমীক্ষা দেখে পথের ধারের চেনা রুটিওয়ালা বা ইস্তিরিওয়ালা যে কিনা অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে, যার উপস্থিতিতেই পরিচিতির উত্তাপ থাকে, নগর পরিকল্পনার নামে তাদের ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অপারেশন সানশাইনের ঠিক পরের গড়িয়াহাটের ফুটপাথ মনে পড়বে। সমীক্ষা আরও দেখে, গাড়ি পার্কিং-এর জায়গাগুলিতে আলো থাকে না, ফলে গাড়ি বার করতে গিয়ে একলা মেয়েরা অস্বস্তিতে ভোগেন। বিশেষ ভাবে বলতে হয় মেয়েদের শৌচাগারগুলির কথা নোংরা, দরজা ভাঙা, ভাল হলে দেখা যাবে পুরুষরাই ব্যবহার করছে। সাবওয়ের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কমছে আলো, কোথা দিয়ে ঢুকতে-বেরোতে হবে সে সব লেখা বোর্ডের সংখ্যা নগণ্য, তাই এগুলিতে মেয়েরা মোটেই নিরাপদ বোধ করেন না। সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছিল নানা প্রস্তাব। সে সব প্রস্তাব রূপায়িত হয়নি, দিল্লি শহর বেড়েছে, বেড়েছে যৌন নিগ্রহের খতিয়ানও।
শুধু দিল্লি নয়, সব শহরেই এমন জায়গা আছে, যেখানে মেয়েরা স্বস্তি বোধ করেন না। পুলিশের খাতা থেকে নারীনিগ্রহের খতিয়ান নিয়ে সে সব জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে যথেষ্ট আলো আর বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা যায় না? প্যারিস শহরের কোন কোন মহল্লা পর্যটকদের জন্য নিরাপদ নয়, তা নিয়ে ফরাসি সরকারের একটি মানচিত্র ওয়েবসাইটে ছিল, সে রকম মেয়েদের জন্য নিরাপত্তার একটি মানচিত্র তো প্রশাসকরা চাইলেই বানাতে পারেন। তবে, নজরদাররাই যদি মনে করেন মেয়েদের ‘বাহিরের’ পরিসরে আসা ঠিক নয়, তাদের উপযুক্ত জায়গা হল অন্দরমহল, এমনকী যদি কাজেকর্মে বেরোতেও হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত? মেয়েরা নিগ্রহের শিকার হলে তাঁরা তো মনে করবেন সে মেয়ে ‘উচিত’ শাস্তি পেয়েছে! তাই নজরদারদের দেখার চোখগুলোকেও বদলাতে হবে। দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনাটির জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হল। তার পর কি সেই তদন্ত এগোবে? নির্ভর করছে অপরাধীদের পয়সার জোর কত, রাজনৈতিক যোগাযোগ কত। কলকাতায় পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে তদন্ত করতে গিয়ে প্রথম দোষী সাব্যস্ত হলেন সৎ পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেন, আর এগারো মাস পরেও সেই কেসের চার্জশিট দিল না পুলিশ। |
‘ফাঁসি চাই’ |
অবস্থানকারীদের এক বিরাট অংশের দাবি অভিযুক্তদের প্রাণদণ্ড। ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি এই দাবিটির পিছনে আছে যে মনোভাব তা হল, ধর্ষণ হত্যার সমান। কেন সমান? মেয়েদের ‘ইজ্জত’ প্রাণের সমান বলে? এই অবস্থান কিন্তু আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কিত ধারণাকেই চিনিয়ে দেয়। যেন মেয়েদের জীবনের একমাত্র সার্থকতা সতী হয়ে বিবাহ করে ঘরের মধ্যে বদ্ধ থাকা। ধর্ষণ নারীদের ওপর বিভিন্ন অত্যাচারের অন্যতম একটি উপায়, এর সঙ্গে নারীর সমগ্র জীবনের কোনও যোগ নেই। ধর্ষণের এই হইচইয়ে সতীত্বের জয়গান গাওয়া মৌলবাদীরাও মিছিলে চলে এসেছেন, খাপ পঞ্চায়েতরাও এলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য আইন বদলে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা বলতে হয়তো তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন: যেখানে ধর্ষণে সর্বোচ্চ কারাদণ্ড হতে পারে যাবজ্জীবন কারাবাস, সেখানে আরও কঠোর শাস্তি বলতে হয় যাবজ্জীবন বলতে সত্যিই সারা জীবন, নয়তো ‘রেয়ারেস্ট অব রেয়ার’ ঘটনায় প্রাণদণ্ড। ২০১১ সালে ৩৬.৬ শতাংশ ধর্ষণের অভিযোগে কোনও তদন্তই হয়নি, আর ১৯৭১ সাল থেকে ২০১২ সালে ধর্ষণে শাস্তির হার ৪৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২৬ শতাংশ। ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৪৫৬টি প্রাণদণ্ডের আদেশ সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছে। ফাঁসি হয়েছে মাত্র একটি ক্ষেত্রে। এই যদি হয় তদন্ত, রায়দান আর শাস্তির হার, তা হলে আরও কঠোর শাস্তি, এক কথায় প্রাণদণ্ডের দাবির কোনও ভিত্তি আছে কি? না কি প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশিকা মেনে পুলিশ, সরকারি চিকিৎসক এবং বিচারব্যবস্থা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে, সে জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া জরুরি? ‘মেয়েটি নিশ্চয় সম্মত ছিল, এখন কোনও কারণে বিগড়ে বসেছে’ এমন মনোভাব নিয়ে সন্ধান বা বিচার শুরু করলে সত্যপ্রতিষ্ঠা কখনওই সম্ভব নয়। শরীরটি মেয়েটির নিজস্ব, একান্ত কাছের মানুষও তা নিয়ে জোর করতে পারেন না।
রাজনৈতিক দলের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা তলানিতে। আজ সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলদের বাধ্য করেছেন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে। তাই এখনই লোকসভায় যৌননিগ্রহে অভিযুক্ত যে ৩০ শতাংশ সদস্য আছেন, তাঁদের নিয়ে পুনর্বিবেচনা জরুরি। আর জরুরি এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ কী ভাবে আনা যায়, সেটা ভাবা। কঠোরতম রূপায়ণ সুনিশ্চিত করতে পারলে তবেই আস্থা ফেরানো সম্ভব, জলকামান আর ১৪৪ ধারা দিয়ে নয়। |
|
|
|
|
|