বিপদে পড়িলে অর্ধেক ত্যাগ করাই নাকি বিচক্ষণতার কাজ। সচিন তেন্ডুলকরও করিয়াছেন। কেন সচিন এখনও খেলিয়া চলিয়াছেন, গোটা ক্রিকেট-বিশ্ব জুড়িয়া এই প্রশ্ন উঠায় তিনি ঘোষণা করিলেন, আর এক দিনের ম্যাচ খেলিবেন না। এই ঘোষণায় তাঁহার বাকি অর্ধেক রক্ষা পাইল কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু ‘সচিন তেন্ডুলকর’ নামক রূপকথাটির গায়ে আঁচড়টি আরও বাড়িল। গত সিকি শতাব্দী জুড়িয়া তিনি বাইশ গজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক। ভয়ঙ্করতম বোলারও তাঁহাকে সমীহ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। আর সেই তিনি কি না প্রশ্নবাণে জর্জরিত খেলা ছাড়িতেছেন না কেন? এই প্রশ্নে তিনি যতখানি আহত, প্রশ্নকর্তারাও ততখানিই। ভারত যাঁহাকে ‘ক্রিকেটের ঈশ্বর’ জ্ঞান করিয়াছে, তাঁহাকেও যে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হইতেছে, তাঁহাকে যে এই প্রশ্নগুলি করিতে হইতেছে, ক্রিকেটপ্রেমীদের নিকট তাহা হৃদয়বিদারকই বটে। কিন্তু ইহারই নাম বাস্তব। রূপকথা হইতে বাস্তবে নামিয়া আসিলে এই ধাক্কা লাগিবেই। আরও একটি ধাক্কার ক্ষেত্র তিনি স্বয়ং প্রস্তুত করিয়া রাখিলেন অর্ধেক ত্যাগ করিতে অসম্মত হইয়া। তিনি অস্ট্রেলিয়া সিরিজের অপেক্ষায় রহিয়াছেন। সেই সিরিজে হয়তো তিনি রান পাইবেন, হয়তো তাঁহার ব্যাটে রানের খরা দীর্ঘায়িত হইবে। কিন্তু তিনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকিবেন না। কেন তিনি এখনও খেলিয়া চলিতেছেন, কেন তাঁহার পা নড়িতেছে না, কেন কোনও সাধারণ মানের বোলারও তাঁহাকে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়া অনায়াসে বোল্ড করিতে পারিতেছে, এই প্রশ্নগুলি বারংবার উচ্চারিত হইবে। হয়তো এমন লোকের মুখে, যাঁহারা ক্রিকেট-প্রতিভায় তেন্ডুলকরের সঙ্গে সুদূর তুলনাতেও আসিতে পারেন না। হায়! তেন্ডুলকর নিজেকে বর্মহীন করিয়াছেন। যে ব্যাট তাঁহার হইয়া কথা বলিত, তাহার জবাব আর এখন যথেষ্ট হইবে না।
সচিন তেন্ডুলকর অসামান্য ক্রিকেটার। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে প্রত্যেককেই থামিতে হয়। ডন ব্র্যাডম্যান থামিয়াছিলেন, সুনীল গাওস্কর, ভিভিয়ান রিচার্ডসও। ফলে, সচিন তেন্ডুলকর যে মাপের খেলোয়াড়ই হউন না কেন, তাঁহাকেও অবসর লইতেই হইবে। কখন, তাহাই প্রশ্ন। স্পষ্টতই তেন্ডুলকর এখনও মনে করেন যে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁহার আরও কিছু করিবার আছে। অতএব তিনি খেলা চালাইয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কিন্তু তেন্ডুলকর ভারতীয় দলে খেলিবেন, এই সিদ্ধান্তটি একা তাঁহার হইতে পারে না। যাঁহারা দল নির্বাচন করেন, বোর্ড চালান, তাঁহারাও স্থির করিবেন যে তেন্ডুলকর আদৌ খেলিবেন কি না। তাঁহারা স্পষ্টতই ‘সচিন তেন্ডুলকর’ নামের ওজনের সম্মুখে ভীত। তেন্ডুলকরকে বাদ দিয়া দল গড়িবার সাহস তাঁহাদের নাই। কেন, সেই কারণটি দুর্জ্ঞেয়। বোর্ড পূর্বে বহু বড় মাপের খেলোয়াড়কে বাদ দিয়াছে। তেন্ডুলকর যত বড় খেলোয়াড়ই হউন, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের ঊর্ধ্বে নহেন। তিনি আজ অতীত। ভারতীয় ক্রিকেটকে যদি বাঁচিতে হয়, ভবিষ্যতের দিকে চাহিতে হইবে। সেই ভবিষ্যতে তেন্ডুলকর হইবেন এক অসামান্য প্রেরণা। প্রেরণাই।
বোর্ড যদি তাঁহাকে বাদ দিতে ইতস্তত করেও, তিনি নিজেই বা ছাড়িলেন না কেন? ক্রিকেট হইতে তাঁহার আর কী পাওয়ার আছে? ব্যাটিংয়ের যতগুলি বিশ্বরেকর্ড সম্ভব, সবই তাঁহার দখলে। কিছু শৃঙ্গ এমনই দুর্জয় যে সম্ভবত তাঁহার জীবদ্দশায় সেই রেকর্ডে হাত পড়িবে না। তিনি ভক্তদের নিকট ‘আধুনিক ক্রিকেটের ঈশ্বর’ রূপে স্বীকৃতি পাইয়াছেন। নাম, যশ, অর্থ কিছুই কম পড়ে নাই। তবে তিনি কীসের অপেক্ষায় রহিয়াছেন? কেন নিজের মুকুটকে এই অসম্মানের ধুলায় লুটাইয়া ফেলিতেছেন? একটিই কারণ অবশিষ্ট থাকে তাঁহার ভক্তরা তাঁহার উপর যে দেবত্ব আরোপ করিয়াছে, তিনি কি স্বয়ং সেই দেবত্বে বিশ্বাস করিয়া ফেলিলেন? তিনি কি নিজেকে ‘ঈশ্বর’ ভাবিলেন? যদি তাহাই হয়, তবে তাহা আরও গভীর বেদনার কারণ। যে দেবত্ব তাঁহাতে অর্পিত হইয়াছে, তাহার সম্মানরক্ষার দায়িত্বও তাঁহারই। তিনি খেলিতে শিখিয়াছেন, খেলা থামাইতে শেখেন নাই। শুধু এই কারণেই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সুনীল গাওস্করের আসনটি তাঁহার অধরা থাকিয়া গেল। |