শুধু নিরাপত্তা নয়, চাই মানসিকতায় বদল
ত রাগ আর ক্ষোভ জমা ছিল দিল্লিবাসীর মনে?
কখনও বুঝতেও পারিনি। বরং মনে হতো যে, দিল্লি শহর যেন বড় বেশি নিজেকে নিয়ে মগ্ন ও ব্যস্ত। ১৬ তারিখের গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ-আন্দোলনের সাক্ষী হল রাজধানী, তা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। মানুষের ক্ষোভ উত্তাল হয়ে আছড়ে পড়ল ইন্ডিয়া গেট, বিজয় চক, রেল ভবনের সামনে।
নিজেকে প্রশ্ন করেছি, হঠাৎ একটি ধর্ষণের ঘটনাকে সামনে রেখে কেন দেখা দিল এই প্রবল বিক্ষোভ? কোন সামাজিক অথবা রাজনৈতিক কারণে তৈরি হল এই বিপুল ক্রোধ?
এমন ঘটনা তো নতুন কিছু নয় আমাদের দেশে!
আসলে এই ক্রোধের নানা রকম কারণ রয়েছে। প্রথমত, ঘটনাটি এতটাই নৃশংস যে জনতার রাগ বল্গাহীন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এর চরিত্র এমনই যে দিল্লির মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্রুত সমব্যথী হয়ে পড়েছে। রাত সাড়ে ন’টায় একটি মেয়ে বাসে করে বাড়ি ফিরছেন (তাও একা নন)। এটা এতটাই স্বাভাবিক আর দৈনন্দিন ঘটনা যে দিল্লির সব ছাত্রী বা অফিস-কাছারিতে যাওয়া মহিলা চট করে একাত্মতা বোধ করেছেন, পরিণাম দেখে শিউরে উঠেছেন।
ঘটনার ঠিক পরেই সরকারের উচিত ছিল বুক চিতিয়ে
মানুষের ক্ষোভের মুখোমুখি হওয়া।

শর্মিলা ঠাকুর
মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটা ধারণা চালু আছে যে, কোনও মেয়ে অশালীন পোশাক পরলে বা পার্টি থেকে ফিরলে যেন ধর্ষিতা হলেও হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো তেমন কিছু ঘটেনি। তৃতীয়ত, প্রাথমিক ভাবে সরকারের মুখে কুলুপ এঁটে থাকাটাও মানুষ ভাল ভাবে নেননি। ঘটনার ঠিক পরেই সরকারের উচিত ছিল বুক চিতিয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখোমুখি হওয়া। সনিয়া গাঁধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, শীলা দীক্ষিত অথবা সুশীলকুমার শিন্দে, যে কেউ বিবৃতি দিতে পারতেন। সম্ভব হলে বড় স্ক্রিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তা দেখানো যেতে পারত। তাতে ক্ষততে কিছুটা হলেও মলম পড়ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে গুলি চলার পরে বারাক ওবামা কিন্তু ঘটনা না-এড়িয়ে, মানুষের মুখোমুখি হয়েছেন। যে কোনও সঙ্কটে সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া সব সময় কাম্য।
এই সব কারণেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। প্রথমে তা ছিল নেতৃত্বহীন। পরে অবশ্য কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছে, যারা আন্দোলনকে হিংসাত্মক করে তুলেছে। দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির আনাগোনাও। তবে বিক্ষোভে মূলত যোগ দিয়েছেন দিল্লির মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষই। বিহার বা উত্তরপ্রদেশে, ভূমিহার অথবা দলিত কন্যা ধর্ষণের অজস্র ঘটনায় যা দেখা যায় না। কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে বা লুটপাট হলে সবার আগে লাঞ্ছিত হন মহিলারাই। একে নিছক যৌন-বিকৃতি হিসেবে দেখা কিন্তু ঠিক হবে না। এ সব ক্ষেত্রে মহিলাকে ধর্ষণ করে এক ধরনের ক্ষমতার আস্ফালনই (পাওয়ার ট্রিপ) দেখানো হয়। মহিলাকে অপমান করে গোটা সম্প্রদায়কেই অপমান করার চেষ্টা করে পুরুষরা। কিন্তু প্রশ্ন হল, তখন তো কোনও আধুনিক শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে এ ভাবে রাস্তায় আছড়ে পড়তে দেখি না। দিল্লিতে তো নয়ই। পাশাপাশি আর একটি কথাও বলে নেওয়া দরকার। তা হল, চোখের সামনে নারী-লাঞ্ছনা ঘটলে কি প্রতিবাদে মুখর হয় মধ্যবিত্ত মানুষ? বোধহয় না। টাটকা একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাসে গণধর্ষণ নিয়ে যখন রাজধানী উত্তাল, ঠিক তখনই, রবিবার বিকেলে এই দিল্লিতেই ডিটিসি বাসে নিগৃহীত হয়েছেন এক কুড়ি বছরের গর্ভবতী মহিলা। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামীও। স্বামীর অভিযোগ, চার জন মত্ত যুবক তাঁর স্ত্রীর প্রতি অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে, তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
বাসে বেশ কয়েক জন উপস্থিত থাকলেও কেউ কিন্তু টুঁ শব্দটিও করেনি।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? এক, দলিত বা আদিবাসী শ্রেণির মহিলাদের অভিযোগকে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সমীকরণের ঘেরাটোপে ফেলে নিশ্চিন্ত মধ্যবিত্ত। দক্ষিণ দিল্লিতে, চোখের সামনে, পরিচিত শ্রেণির মধ্যে ঘটা ঘটনাই তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। দুই, মধ্যবিত্ত শ্রেণি দলবদ্ধ ভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় তার সাহসে কুলোচ্ছে না।
• জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী: রাগ হতেই পারে, কিন্তু হিংসায় কাজ হয় না।

• অবস্থা আরও আশঙ্কাজনক তরুণীর। রক্তে সংক্রমণ। খোঁজ নিলেন রাষ্ট্রপতি।

• সাম্প্রতিক ধর্ষণের মামলাটির ৩ জানুয়ারি থেকে রোজ শুনানি। ৭ দিনে চার্জশিট।

• মহিলাদের জন্য কেন্দ্র ও দিল্লি সরকারের হেল্পলাইন চালু। নম্বর ১৮১ ও ১৬৭।

• ফৌজদারি আইন খতিয়ে দেখতে বিশেষ কমিটির কাজ শুরু।

• দিল্লি পুলিশের দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে সাসপেন্ড।

• দিল্লি কার্যত দুর্গ। ৯ মেট্রো স্টেশন বন্ধ সোম, মঙ্গলও। কমেছে বিক্ষোভের তীব্রতা।

• বিক্ষোভের জেরে ৭ রেস কোর্সে সরলো পুতিন ও মনমোহনের বৈঠক।
পুরুষশাসিত সমাজও এই অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ী। জীবনবিমার বিজ্ঞাপন খেয়াল করে দেখুন। মেয়েদের বিয়ের জন্য টাকা জমানো বাবা-মায়ের লক্ষ্য। অথচ ছেলের জন্য চাই উচ্চশিক্ষার খরচ! এটা দুর্ভাগ্যের যে, আমাদের দেশে ছেলে আর মেয়েকে একই ভাবে বড় করা হয় না। কাজ, শিক্ষা, খাদ্য কোনও ক্ষেত্রেই সমান চোখে দেখা হয় না। অবাধে ঘটে নারী ভ্রূণহত্যার মতো অপরাধ।
এই সুযোগে একটা কথা বলি। কোনও ধর্ষণকারীই তো চাঁদ থেকে পড়ে না। তারা আমাদের এই সমাজেই জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। তাদের মনস্তত্ত্বে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, পুরুষ হয়ে জন্মানোর অহং। যার বীজ শুধু ধর্ষণকারীর ভিতরেই নয়, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যেও রয়েছে। শহর, গ্রাম সর্বত্র পুলিশ কনস্টেবল, বিচারব্যবস্থার নিচুতলার কর্মীসবাই আসছেন এই মানসিকতা নিয়ে। কনস্টেবল নিজেই ধর্ষণ করছে এমন অভিযোগও তো কম নয়।
আবার যিনি ধর্ষিতা হচ্ছেন সেই মহিলার নৈতিকতা (অর্থাৎ তিনি কুমারী কি না, তাঁর পোশাক কী রকম, পেশা কী, কেন রাত করে বাড়ি ফেরেন) নিয়েও চুলচেরা আলোচনা আর বিচার শুরু হয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যেন, যে ধর্ষণ করেছে, সে নিগৃহীতার তুলনায় অনেক বড় মাপের মানুষ!
এই সামাজিক অসুখ থেকে উদ্ধারের কোনও শর্টকাট পদ্ধতি আমার জানা নেই। সরকারের পক্ষেও আশু কিছু করে ফেলা সম্ভব বলেও মনে হয় না। তবে দেখেশুনে যেটুকু মনে হয় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। যার মধ্যে রয়েছে পুরুষ ও নারীকে সমান চোখে দেখার চেষ্টা শুরু করা, পুলিশের মানসিকতার বদল, বিচারব্যবস্থার সংস্কার। আপাতত যেটা করা যায় তা হল, মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আইন আরও মজবুত করা, আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার হার বাড়ানো (এখন যা মাত্র ২৭ শতাংশ)। সেই সঙ্গে রাতের বাস বাড়ানো (অনেক ছাত্রী, কর্মরত মহিলা বাসে যাতায়াত করেন), এবং সম্ভব হলে বাসে মহিলা মার্শাল ও ড্রাইভার রাখা।
এক কথায়, রোগ সারানোর জন্য স্বল্পমেয়াদি কিছু ব্যবস্থার পাশাপাশি দরকার দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা আর মানসিকতার আমূল পরিবর্তন।

সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.