শুরুটা দেখা যাচ্ছে না, শেষটাও না। শুধু দুটো লম্বা সারি। সপ্তাহান্তের শীতের বিকেলের নানা আকর্ষণ উপেক্ষা করে পথে নেমেছে কয়েক হাজার মানুষ। ধর্মতলার মোড় থেকে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল পর্যন্ত হাঁটবেন তাঁরা। দেশ জুড়ে একের পর ধর্ষণের প্রতিবাদে। যে প্রতিবাদের আগুন উস্কেছে দিল্লির ঘটনায়।
কোনও রাজনৈতিক দল বা সংস্থার উদ্যোগে নয়। শুধু ফেসবুকের একটি কমিউনিটির পরিকল্পনায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিলেন এতগুলো মানুষ।
বিকেল ঢলতেই থিকথিকে ভিড় এসপ্ল্যানেড ইস্টে। গড় বয়স কত এই ভিড়ের? কুড়ি-পঁচিশের বেশি নয় কিছুতেই। কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, কেউ সদ্য ঢুকেছেন চাকরিতে। এখানে আসার আগে যাদবপুরের তিনটে দোকানে ঘুরতে হল মোমবাতির খোঁজে। কোত্থাও নেই। গোটা শহরের সব দোকানেই এমন অবস্থা নাকি? শনিবারের বিকেলে সব মোমবাতিই কি জ্বলবে ওই মিছিলে?
খুব ভুল ভাবিনি। কে সি দাসের সামনে থেকে ভিড় এগোতে শুরু করতেই কাঁধ-পিঠের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল একের পর এক মোমবাতি। খুব মসৃণ ভাবে ভিড়টাকে পাশাপাশি দু’টো লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা। একটা-দু’টো মোমবাতি জ্বলে উঠতে ওঁরাই বারণ করলেন। বললেন, পুলিশের বারণ আছে। এত ভিড়ে জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে দুর্ঘটনা হতে পারে। মোমবাতি জ্বলবে গন্তব্যে পৌঁছনোর পর। |
রাস্তার এক পাশ ধরে চলছে দু’টো সারি। কয়েকটা মিনিট থমকে যাচ্ছে ট্রাফিক। পথচলতি অনেকেও দাঁড়িয়ে পড়ছেন। কখনও কখনও চার পাশের সব শব্দ ছাপিয়ে জেগে থাকছে শুধু পায়ের আওয়াজ। একটা মৃদু গুঞ্জন। প্রচণ্ড শৃঙ্খলাবদ্ধ এই মিছিল। ব্যানার আছে, কিন্তু সংখ্যায় খুব অল্প। স্লোগানও উঠছে মাঝে মাঝে। তখন স্বেচ্ছাসেবকরা এসে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এটা ‘সাইলেন্ট র্যালি’। নীরব প্রতিবাদে হাঁটব। তবুও হঠাৎ হঠাৎ ছিটকে আসছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’
সুবিচার চাই। দিল্লি সফদরজঙ্গ হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকা মেয়েটার জন্য সুবিচার চাই। জবাব চাই, কেন রাত দশটায় ভারতের খাস রাজধানীতে ভরসা করে একটা বাসে উঠতে পারে না কোনও কলেজপড়ুয়া মেয়ে? এমন পৈশাচিক কাজ করার আগে কেন ভয় পায় না কিছু লোক? এ দেশের আইন কি এতই ঠুঁটো? সারা দেশ উত্তাল বলেই হয়তো এ যাত্রা ধর্ষকেরা ধরা পড়েছে। কিন্তু তার বাইরে? এই তো পেরিয়ে এলাম পার্ক স্ট্রিটের মোড়। সেই ধর্ষিতা তো আজও সুবিচার পাননি। মূল অভিযুক্ত কোথায়, কেউ জানেই না। |
নিচু গলায় এমন অনেক আলোচনাই হাঁটতে হাঁটতে কানে আসছিল। নীরব মিছিলে ইতস্তত ক্ষোভের স্ফূলিঙ্গ “আর কী ভাবেই বা প্রতিবাদ জানাতে পারি আমরা”, “মোমবাতি কেন, দাবানলেও কিছু হবে না। কালকেই হয়তো আরও একটা ধর্ষণ হবে”, “প্রতিবাদ জানাতে হাঁটছি। সমাধান কি না জানি না।...”
কেন হাঁটছ কলকাতা? কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটলে কি সব ধর্ষক ভাল হয়ে যাবে? জবাবটা দিলেন পাশে হাঁটতে থাকা তরুণী “এটুকুই হয়তো আমি করতে পারতাম। আমিও তো মেয়ে। দিল্লি বলুন, মালদহ, গুয়াহাটি প্রত্যেকটা ধর্ষিতা মেয়ের মধ্যে কি আমি নেই?”
রাস্তার আলো জ্বলেছে। আলো-আঁধারির আবছায়ায় কখন জেগে উঠেছে সেন্ট পলসের চুড়ো। শুনলাম, আমরা যখন বিড়লা তারামণ্ডলের কাছে, তখন নাকি মিছিলের শেষটা সদ্য পার্ক স্ট্রিট ছুঁয়েছে। একটু আগে এক স্বেচ্ছাসেবক জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছেন দু’টো সারির মোমবাতিগুলো। প্রতিবাদ জ্বলছে হাতে-হাতে। হাওয়ায় কাঁপতে থাকা হাজার নরম আলো আর রাস্তার সোডিয়াম ভেপার মিশে গলে পড়ছে পিচরাস্তায়।
সত্যিই, এটুকুই হয়তো করতে পারত কলকাতা। এটুকুই বা কম কী? কাঁদানে-গ্যাস জলকামানের সঙ্গে লড়াইয়ের বাইরেও একটা লড়াই আছে। নীরব লড়াই। কলকাতা তার মতো করেই জানিয়ে গেল সমস্ত রাগ-অভিমান। |