|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্টলজ্জা[ঘেন্না] |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুদ্দম একেবারে বাচ্চাকালের ছড়া, আর তখন থেকেই রেলগাড়ি নিয়ে রোমান্টিসিজ্মের শুরু আমাদের। মানে, আমরা যারা বিশ্বায়নের আগে অন্তত কিছু বছর নিস্তরঙ্গ জীবন কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেছি। আর তাই রেলগাড়ি, বুড়ির চুল, লোডশেডিংয়ের গরমের দুপুর, এখনও আমাদের ফেভারিট। আমার এক বান্ধবী অবশ্য রেলগাড়ি, তার আওয়াজ, দূরপাল্লার বেড়ানো, ট্রেনের জানলার লোহা-লোহা গন্ধ, ঠা-ঠা মাঠের পাশে ট্রেনের দাঁড়িয়ে পড়া, সবেতেই পাগল-পাগল ভাল-লাগা খুঁজে পেত।
সেই বান্ধবী বেশ কিছু বছর আগে একা একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিল। আর কোথায়? রেললাইনের ধারেই। মানে সেলিব্রেশনের চূড়ান্ত। জীবন দু’হাত ভরে হরির লুট দিয়েছে। একে সদ্য-অর্জিত একলা থাকার স্বাধীনতা, তার ওপর বাড়িটা রেললাইনের ধারে।
সেই বাড়িতে প্রথম দিন আমরা বন্ধুরা হুল্লোড় করে ওর সংসার সাজালাম, কেউ দুটো কফি মাগ, কেউ দশ প্যাকেট ম্যাগি, কেউ ইমার্জেন্সি লাইট উপহার দিয়ে। সঙ্গে চলল দেদার পেছনে লাগা আলমারির নাম হল ন’টা পাঁচের লোকাল, বাথরুমের নাম সেকেন্ড ক্লাস ওয়েটিং রুম, শোওয়ার ঘর রাজধানী। আর বারান্দার নাম? অপুদুর্গা!
বান্ধবী এমনিতেই আর্লি-রাইজার, তার ওপর নতুন জীবন শুরুর আগ্রহে পর দিন আরও ভোরে উঠে পড়ল। গরম চায়ের কাপ নিয়ে অপুদুর্গায় বসে সবে সে জীবন, ভাগ্যবিধাতা, পাড়ার শনিঠাকুর, ছোটকাকুকে (বাড়ির বিজ্ঞাপনটা কাগজে তিনিই আবিষ্কার করেন) প্রাণপণ ধন্যবাদ দিচ্ছে, এমন সময় চোখ চলে গেল অমোঘ একটি দৃশ্যে সারি সারি কচিকাঁচা, মাঝবয়সী লোক, ঘোমটা টানা বউ, সব্বাই লাইন দিয়ে বসে আছে রেললাইনে। প্রাতঃকৃত্য সারছে। কাশবনে অপুদুর্গার থেকে দড়াম করে জাম্পকাট টু খরখরে বাস্তব। কিছু ক্ষণ তাদের অবহেলা করে রেললাইনের দিকে অনাগত রেলগাড়ির প্রতীক্ষায় তাকিয়ে থাকা অভ্যেস করলেও, চোখ বারে বারে সেই তৃতীয় বিশ্বের অবধারিত কিন্তু ‘সুবিধের নয়’ দৃশ্যের দিকেই চলে যেতে লাগল।
মোটেই সুখকর নয়। চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গেও কি গন্ধ উঠে আসছে তা হলে? অগত্যা বারান্দা ছেড়ে ঘরে। পর দিন আরও ভোরে উঠে বারান্দায় যেতেই ফের একই দৃশ্য। অপুদুর্গায় যাওয়া বন্ধ হল। কিন্তু জানলা দিয়ে তাকালেও ওই এক সিন। তবে তার সকালগুলো রেলগাড়িময় হওয়ার বদলে কী হবে?
এ বার ঘেন্না শুরু হল। নিজের অজান্তেই। ট্রেনের আওয়াজ শুনলেই তার মনে পড়ে যায় সেই দৃশ্য। অসংখ্য কালো কালো নিতম্ব থেকে হলুদ বর্জ্য পদার্থ। এমনকী সিনেমায় রেললাইন দেখলেও সে গন্ধ পায়, অজান্তে নাক চেপে ধরে, ভেতরটা গুলিয়ে ওঠে, মাথা ঝিমঝিম করে। বাড়ি ছাড়ে।
সাইকায়াট্রিস্ট দেখায়। চেষ্টা করে কাটিয়ে ওঠার। কিন্তু ফল হয় না। রেললাইনের ধারে-কাছে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। মনে হয় অবধারিত মাড়ালাম হলুদ পিণ্ড। কাউন্সেলিং চলতে থাকে।
নিস্তার হয় না। এখনও সেই ঘেন্না বয়েই তার জীবন। বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ রায়, ছোটবেলার দূরপাল্লার বেড়ানো, ট্রেনের ডাক, সব মিলিয়ে যে রোম্যান্টিসিজ্ম ফুলেফেঁপে উঠেছিল, তার মৃত্যু হল নিতান্তই তীব্র ওয়াক ওয়াক এবং অনেক ওয়াকে। |
|
|
|
|
|