|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: মেনটেন্যান্স আর্ট |
গৌতম চক্রবর্তী |
যে রাঁধে, সে ইনস্টলেশনও করে! ১৯৭৩ সালে আমেরিকার হার্টফোর্ড কানেক্টিকাট শহরের ওয়াডসওয়ার্থ আথেনিয়ামে অন্য রকম এক প্রদর্শনী। মহিলা শিল্পীদের চিত্রকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। দেখা গেল, মিয়েরলি ল্যাডারমান ইউকেল্স সেখানে সিঁড়ি ধোয়ামোছা করছেন, শিশুসন্তানকে পিঠে নিয়ে রান্নাবান্না করছেন। জনা কয়েক ইন্টারভিউয়ার টেপ রেকর্ডার নিয়ে। দেওয়ালে ইউকেল্সের রান্না করা, ঘর সাজানো, বাড়ি সাফসুতরো করার ছবি। টেপ রেকর্ডার থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন মহিলার অভিজ্ঞতা! কী ভাবে প্রতি দিন বাজারহাট, ঝাড়ামোছা, রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে স্বামীকে সামলানো, সবই করতে হয় তাঁদের!
দর্শকেরা প্রথমে হতবাক। কিন্তু শিল্প কি শুধুই ড্রয়িং রুমের অন্দরসজ্জা? আর্ট গ্যালারির শোভনসম্ভার? ইউকেল্স তিন বছরের এক শিশুর জননী। যে শিল্পী ছবি আঁকছেন, তিনিই বাচ্চার ন্যাপি বদলাচ্ছেন, স্বামীকে খাইয়েদাইয়ে অফিস পাঠাচ্ছেন এবং পর মুহূর্তে সুপারমার্কেটে ছুটছেন। তিনি কি শুধু ছবি আঁকা, ভাস্কর্য গড়াকেই গুরুত্ব দেবেন? অন্য কাজগুলি এলেবেলে?
এই প্রদর্শনীর আগের চার বছর ধরে ইউকেল্সকে এই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে। ১৯৬৯ সালে এক প্রদর্শনীর দেওয়ালে তিনি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখা ‘ম্যানিফেস্টো ফর মেনটেন্যান্স আর্ট’। ‘সংস্কৃতির মেনটেন্যান্স বা রক্ষণাবেক্ষণেই গুরুত্ব সবচেয়ে কম। গৃহবধূদের তাই বেতন নেই।’ কিংবা ‘আমি রান্না করি, কাপড় কাচি, বাসন মাজি, ঘর ঝাঁট দিই, সব কিছুকে ফের নতুন করে তুলি, আমি আলাদা ভাবে শিল্পও করি’ ইত্যাদি বাক্য ছড়িয়ে আছে সেই ম্যানিফেস্টোয়। নারীবাদী দৃষ্টিতে এই প্রথম দেখা হয়েছে শিল্পকে।
নারীবাদ শব্দটা শুনলে বাঙালি পুরুষের ঠোঁটের কোণে আজকাল বিদ্রুপের চিলতে হাসি খেলে যায়। কিন্তু ১৯৬৯ সালটা ভাবতে হবে। প্যারিসে ছাত্র আন্দোলন, ভিয়েতনামে দাদাগিরি করতে গিয়ে ল্যাজ গুটিয়ে জেরবার আমেরিকা। পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কেও উতরোল! দুই দশক আগে বেরিয়ে গিয়েছে সিমোন দ্য বেভোয়ার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। ’৬৯ সালেই ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় ক্যারোল হানিস সটান বলে দিয়েছেন, নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যক্তিগত পরিসরও রাজনীতির বাইরে নয়। তাঁর ভাষায়, পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল! ওই সময়েই সুদূর সিডনিতে বসে জার্মেন গ্রিয়ার নামে এক ভদ্রমহিলা শেষ করে ফেলেছেন তাঁর পান্ডুলিপি। পরের বছর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন জাগাবে তাঁর ‘দ্য ফিমেল ইউনাক’। ইউকেল্স, ক্যারোল হানিস বা জার্মেন গ্রিয়ার পরস্পরকে চিনতেন না। কিন্তু সময় তাঁদের একই ভাবে ভাবাচ্ছিল। সংকটের সময় শিল্প গজদন্তমিনারে বসে থাকে না, আর পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে মিলেমিশে সে সমাজকে প্রবল চপেটাঘাত করে। |
|
দুই বিপ্রতীপকে এক সঙ্গে মিলিয়ে দেয় ইউকেল্সের ম্যানিফেস্টো। বলা হয়, দুনিয়ায় দুটি আলাদা প্রবৃত্তি। প্রথমটি মৃত্যুর। পৃথক হওয়া, ইন্ডিভিজুয়ালিটি বা ব্যক্তিচেতনা, আঁভা গার্দ মানসিকতা আসলে নিজের মৃত্যুর পথ নিজে বেছে নেওয়া। আর জীবনের প্রবৃত্তি? একত্রে থাকা, বেঁচে থাকার উপযোগী সার্ভাইভাল সিস্টেম, প্রজাতির রক্ষণাবেক্ষণ ও তাকে এগিয়ে নিয়ে চলা।
প্রজাতিকে এগিয়ে নিয়ে চলার অগ্রগামী দর্শন? আলোকপ্রাপ্তির যুগ থেকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অবধি সকলে ওই পথেই বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু ’৬৯ সালের ‘মেনটেন্যান্স ম্যানিফেস্টো’ আলোকপ্রাপ্তি, বিপ্লবের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে গেল। ‘বিপ্লবের পর সোমবার সকালে কাকে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে?’ ম্যানিফেস্টোয় প্রশ্ন তুললেন ইউকেল্স। কত যে কাজ! ‘ঘর মোছো, কাপড় কাচো, বাগানের বেড়া ঠিক করো, ঠিকঠাক রিপোর্ট লেখো, চুল পরিষ্কার রাখো, আমার পারফিউম শেষ হয়ে গিয়েছে, একাধিক বার বললেও সংসারের পুরুষটি রা কাড়বে না, শিল্প ধুলোময়, টেবিলটি পরিষ্কার করো, টয়লেট ফ্লাশ করো, নিজেকে তরুণ রাখো’ জানাচ্ছে ম্যানিফেস্টো। শিল্প, জীবন, সমাজ, রাজনীতি, নারীচেতনা মিলেমিশে একাকার। ‘আমি রোজকার কাজগুলি নিয়মমাফিক করি, চেতনার মধ্যে সেগুলি ফ্লাশ করে দিই, পরে সেগুলিকে শিল্প বলে ‘এগ্জিবিট’ করি,’ বলেছেন ইউকেল্স।
কিন্তু ‘মেনটেন্যান্স আর্ট’ মানে? ওই যে, প্রজাতিকে ‘মেনটেন’ করা, অগ্রগতি বজায় রাখা। পরিবর্তনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পরিবর্তন বা ‘চেঞ্জ’ শব্দটা বারংবার এসেছে ম্যানিফেস্টোয়। জীবন-প্রবৃত্তি আর মৃত্যু-প্রবৃত্তির মতো শিল্পেও দুটি ধারা দেখেছেন ইউকেল্স। প্রথমটি ‘ডেভেলপমেন্ট’ বা উন্নতি। নিখাদ ব্যক্তিগত সৃষ্টি, অগ্রগতি, নতুনত্ব, পরিবর্তন, উত্তেজনাকে নির্দেশ করে সে। দ্বিতীয় ধারা ‘মেনটেন্যান্স’। সৃষ্টি থেকে ধুলো ঝাড়ো, নতুনকে বাঁচিয়ে রাখো, পরিবর্তন বজায় রাখো, অগ্রগতিকে সুরক্ষিত রাখো...সেটাই ‘মেনটেন্যান্স’।
এই বিশ্বাস থেকেই তৈরি হয়েছিল ইউকেল্সের ‘টাচ স্যানিটেশন’ বা ‘আই মেক মেনটেন্যান্স আর্ট ওয়ান আওয়ার এভ্রিডে’ প্রকল্প। ‘টাচ স্যানিটেশন’ মানে, সারা বছর ধরে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ৮৫০০ ঝাড়ুদার, জমাদারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন ইউকেল্স। সে সব ফোটোগ্রাফের পাশাপাশি টেপ করছেন তাঁদের কথা। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প, ভয়, আশঙ্কা। ‘আই মেক মেনটেন্যান্স আর্ট’ প্রকল্পে ম্যানহাটানের ৩০০ ব্যাঙ্ক কর্মচারীর ছবি ও কথোপকথন। তাঁদের রোজকার দায়িত্বটি কি কাজ? না, শিল্প? দেখা গেল যিনি আজ নিজের চাকরিকে একঘেয়ে বলছেন, পর দিন কথা বলতে বলতে তিনিই সেই কাজকে শিল্প বলে বর্ণনা করছেন। ফোটোগ্রাফি, পারফরম্যান্স, সব মিলেমিশে একাকার, শিল্পের সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছে আস্ত একটা কমিউনিটি।
এটুকুতেই শেষ নয় ওই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব। আমেরিকায় বিভিন্ন ‘মেরিন ট্রান্সফার স্টেশন’ থেকে বর্জ্য পদার্থ ভর্তি বার্জ ছাড়ে, সেগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে মাটি ভরাট করে আসে। নয়ের দশকে ইউকেল্স এক মেরিন ট্রান্সফার স্টেশনে ‘ইনস্টলেশন আর্ট’ তৈরি করলেন। স্টেশনের পূর্ব দিকে একটি শহরের মডেল। পশ্চিমে বর্জ্যভর্তি বিভিন্ন বার্জের ছবি। দক্ষিণ দিকে ভিডিয়ো মনিটর। সেখানে সাধারণ মানুষ থেকে বাস্তুতন্ত্র-বিশারদ সকলে তাঁদের মন্তব্য জানাবেন, প্রয়োজনীয় তথ্য দেবেন।
ইকোলজিকাল আর্ট? ’৬৯ সালের ম্যানিফেস্টোয় শেষ অনুচ্ছেদে চারটি দাবি। প্রতি দিন আর্ট গ্যালারিতে পাঠানো হোক
(১) ট্রাক ভর্তি বর্জ্য,
(২) দূষিত বায়ু,
(৩) হাডসন নদীর দূষিত জল,
(৪) খরায়, বন্যায়, যুদ্ধে বিধ্বস্ত মাটি। ‘আমরা প্রতিটি কন্টেনার যথাযথ সার্ভিসিং করে দূষণহীন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ পাঠিয়ে দেব। প্রদর্শনীর পুরো সময়টা সার্ভিসিং চলবে’, লিখেছিল ম্যানিফেস্টো। তাই শুধু ফেমিনিস্ট আর্ট নয়। আজকের গ্রিন আর্টও পথ খুঁজে পেয়েছিল ইউকেল্সের ‘মেনটেন্যান্স ম্যানিফেস্টো’ থেকে।
মেনটেন্যান্স আর্ট ম্যানিফেস্টো অনুপ্রাণিত জো হ্যানসন-এর শিল্প ‘এসএফ স্ট্রিট সুইপিং’। সেপ্টেম্বর, ২০১২। ‘উইমেন এনভায়রনমেন্টাল আর্টিস্টস ডিরেক্টরি’ আয়োজিত প্রদর্শনী। |
|
|
|
|
|