|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র
|
জেলে যেতে হবে।
রাতে ভাল করে ঘুম হয়নি। বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি। হাজারটা প্রশ্ন করবে সবাই। উত্তর দেওয়াটা সহজ নয়। ভোর নয়, শেষ রাতেই উঠে পড়লাম। বেশি করে চায়ের জল চাপালাম। জেলের চা কেমন জানি না। আমাদের বাড়ি থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল বেশি দূরে নয়, আদিগঙ্গার ওপরের ব্রিজ থেকেই জেলের উঁচু লাল দেওয়ালটা দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। বড় ফটকটাও চেনা। এ বার ভেতরটা দেখতে হবে। হেঁটেই রওনা হলাম সকাল সকাল। বলে রাখা ভাল, আমাকে ঠিক ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। আমাকে নিয়ে যাবেন এক জন চিত্রকর। আসবেন ঠিক ন’টায়। আগেই পৌঁছলাম। চা খেলাম গেটের বাইরে, উল্টো দিকের ফুটপাথে।
বড় দরজার কিছুটা পরে আর একটা দরজা, গরাদ লাগানো। রক্ষীরা আছেন। বোধ হয় আগে বলা ছিল, আমাদের কাগজটা এক ঝলক দেখে রক্ষী বললেন, ‘চলে আসুন।’ মস্ত বড় জায়গা। প্রচুর গাছপালা, বাগান। পুরনো লাল বাড়ি, অনেকগুলো। দেখেই বোঝা যায় বেশির ভাগ ব্রিটিশ আমলেই তৈরি। নানা রকম লোকজন ঘোরাঘুরি করছেন। এঁরা নিশ্চয়ই কয়েদি নন। অবশ্য কয়েদিদের কেমন দেখতে হয় সেটা আমার জানা নেই। চার্চ চোখে পড়ল। ঢুকলাম ভেতরে। ছোট সাজানো ঘর, কেউ নেই। যিশুর মুখে চেনা যন্ত্রণা। এসে দাঁড়ালাম একতলা একটা বাড়ির সামনে। তার গায়ে লেখা ‘পাঠ ভবন’।
ক্লাস চলছে। জনা তিরিশেক ছাত্র। বয়স তিরিশ থেকে সত্তর। সাধারণ জামাকাপড় পরা। পড়াচ্ছেন এক জনই। চক দিয়ে বোর্ডে লিখছেন। ইংরেজি গ্রামার চলছে। সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন, নজর রাখছেন ছাত্রদের ওপর। কথাবার্তা বাংলাতেই হচ্ছে। লক্ষ করছিলাম সবার মুখগুলো। যাঁরা বাঙালি, তাঁদের হাবভাব এক রকম। অন্যদের মুখ ভাবলেশহীন। অনেক ক্ষণ পরে পরে তাঁরা খাতায় কিছু কিছু লিখছেন। এক জনের চোখে কালো চশমা। তাঁর পাশে বসলাম, বেঞ্চে। উনি এক বার মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখলেন। খাতাটা চোখে পড়ল, মুক্তোর মতো হাতের লেখা।
এলাম আঁকার ক্লাসে। চার পাশে অজস্র ছবি। বিষয়বস্তুতে চমক নেই, কিন্তু রঙের জোর আছে। প্রকৃতির ছবি বেশি। এক জন এঁকেছেন বন্দিদশার ছবি। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে রোদ পড়েছে ভেতরে, বাইরে সবুজ গাছপালা। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটা মাত্র শুকনো পাতা। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো, চোখে চশমা পরা, খুব শান্ত চেহারার এক ভদ্রলোক কোলের ওপর ক্যানভাস রেখে মন দিয়ে আঁকছিলেন। আর্টিস্ট চিত্তবাবু আমার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললেন, ‘চেনেন? তেলেগু দীপক!’ ট্রিগারের ওপর যে আঙুলের চাপটা মানায়, সেই আঙুলে নিশ্চিন্তে খেলা করছে তুলি। ‘আর ওঁকে চেনেন?’ সাদা লম্বা শার্ট পরা সুভদ্র চেহারার এক জন বয়স্ক মানুষকে দেখালেন, মাথার চুলটা শার্টের চেয়েও সাদা। ‘রশিদ খান। বউবাজার বম্ব ব্লাস্ট!’ খবরের কাগজ পড়ে, টিভি-সিনেমা দেখে অপরাধ-জগৎ সম্পর্কে তৈরি হওয়া নিরেট দেওয়ালে মাথাটা যেন ঠুকে গেল এক বার। কোনও অপরাধীকে নিজের চোখে ভয়ানক কিছু করতে দেখার অভিজ্ঞতা নেই আমার। সবচেয়ে হাই প্রোফাইল দুই বন্দিকে দেখে বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র |
ঘুরে ঘুরে দেখলাম জেলের অনেকগুলো জায়গা। এক জায়গায় পর পর তাঁত চলছে, খটাং-খট শব্দ। এলাম রান্নাঘরে। তাল তাল আটা মাখা চলছে, শ’য়ে শ’য়ে রুটি তৈরি হচ্ছে। সব বন্দিদের নিজস্ব কাজ আছে। ক্যান্টিন রয়েছে, এঁরাই চালান। বেশ পিকনিকের মতো পরিবেশ। সবাই লাইন দিয়ে খাবার নিচ্ছেন। হাসি-গল্পগুজব চলছে। খিদে পেয়েছিল, লাইনে দাঁড়ালাম। বসে গেলাম লম্বা টেবিলে, এল গরম ভাত। হঠাৎ পিঠের ওপর আলতো চাপ। ‘আপনি আমাদের সঙ্গে খাওয়া করছেন, আমি খুব খুশি হয়েছি। ভাল করে খাবেন, কিছু লাগলে বলবেন।’ ভারী গলা। মুখ ঘুরিয়ে দেখি শান্ত, সস্নেহ দৃষ্টি। খাব কী করে? কাঁধের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন রশিদ খান।
জেলের ভেতরেও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা চোখে যত না পড়ে, তার চেয়ে বোঝা যায় বেশি। কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সেটা যেমন নজর রাখা হয়, তেমনই নিজেদের মধ্যে যাতে অশান্তি না হয়, সেটাও দেখা হয়। সবাই যে সবার সঙ্গে মিশতে পারেন, এমন নয়। নিজের কাজ করতে করতেই এক জন হেসে বললেন, ‘এখানে সব ঠিক আছে, কোনও অসুবিধে নেই। বাইরে বেরোলেই ঝামেলা।’ ‘নতুন ব্যবস্থা হয়েছে, কয়েদিরা বাড়ির লোকের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারে, এক বার করে।’ পর পর টেলিফোন বুথ। তার মধ্যে সীমিত সময় কথা বলেই বেরিয়ে আসছেন লোকজন। এ সব কথাবার্তা নিশ্চয়ই রেকর্ড করা হয়। একটা আধখোলা দরজার সামনে যেতেই ভেতরের মানুষটি ঘুরে গেলেন আমাকে দেখে। গলার স্বর আর শোনা গেল না।
জেলবন্দি মহিলাদের দেখতে এলাম। অল্পবয়সি ছাত্রী, সিঁদুর পরা গৃহবধূ, সবাই আছেন। এঁরাও ছবি আঁকেন, নানা হাতের কাজ করেন। নাচ-গান, খেলাধুলো সবই আছে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ মঞ্চস্থ করার ঘটনাটা জানাই ছিল। চোখে পড়ল সরস্বতী ঠাকুর। কোলে বাচ্চা এক জন মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছিল দিদি?’ অম্লান বদনে বললেন, ‘অন্য মেয়ের সঙ্গে সারা ক্ষণ ঢং করত, অনেক বার বারণ করেছি, শুনল না। দিলাম এক দিন চালিয়ে।’
ফিরলাম পুরনো জায়গায়। বিকেলের হলুদ আলো লেগেছে জেলের দেওয়ালে। প্রচুর পাখি ডাকছে চার পাশে। ফেরার সময় হয়েছে। চা খাচ্ছিলাম জেলারের আপিসে বসে, নানা রকম গল্প হচ্ছিল। এক জন কর্মচারী এসে ওঁকে বললেন, ‘স্যর, বুড়ো তো যেতে চাইছে না। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি, গাড়িও রেডি আছে। লোক দিয়ে দিয়েছি, অ্যাড্রেসও আছে।’ ‘তাই? নিয়ে এসো দেখি।’ কোমর বেঁকে যাওয়া, পরিচ্ছন্ন লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন। হাত মুঠো করে নমস্কার করলেন। এক বার মাথা নাড়লেন শুধু। ‘বাড়ি যাবেন তো? নাতি-নাতনিদের কাছে যাবেন তো? আপনার টাকাপয়সা সব ব্যবস্থা করা আছে, গাড়িও আছে, যাবেন তো?’ সঙ্গের এক জন বললেন, ‘অনেক দিনের কেস স্যর, এখনও বলছে মার্ডার করেনি।’ ‘ঠিক আছে, তা এখন কী প্রবলেম? যেতে চাইছেন না কেন?’
ঝাপসা চশমা তুলে তাকালেন বৃদ্ধ। বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমার বাড়ি আর নেই ওখানে। কিচ্ছু নেই, কিন্তু ওরা আছে। ওরা আমায় মেরে দেবে।’ বলে আবার মাথাটা নিচু করলেন। |
|
|
|
|
|