তিন দশক আগে তৈরি হয়েছিল তপন সিংহের ‘আদালত ও একটি মেয়ে।’ যে সিনেমায় গণধর্ষিতা এক স্কুল শিক্ষিকাকে বিচার পেতে আদালতে এবং ঘরে-বাইরে অপমান, হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। অবস্থা কি এখনও বদলেছে? কেন্দ্রীয় সরকারের একটি পরিসংখ্যান বলে, গত আট বছরে নারীর উপরে হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম। দিল্লি, হরিয়ানার থেকেও এই রাজ্যে ধর্ষণ বেশি হয়।
বিচার পাওয়াও সহজ নয়। বিভিন্ন আদালতে মহিলাদের উপরে নির্যাতনের মামলার পাহাড় জমে রয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘ফাস্ট ট্র্যাক আদালত’, তবু ফয়সালা হতে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। অভিযোগকারী মহিলাদেরও ওই সিনেমার চরিত্রের মতোই বারবার নতুন করে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “হাজার হাজার মামলার নিরসন হচ্ছে না।” তাঁর কথায়, “তিন দশকে আইনের পরিবর্তন হয়নি, পরিকাঠামোগত অবস্থারও পরিবর্তন হয়নি। সমাজের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মহিলাদের সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু তাতে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনও অনেকটাই অপরিবর্তিত।” আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, শুধু মেয়েদের জন্য আদালত তৈরির পরিকল্পনা আছে রাজ্যের।
দিল্লির লাক্সারি বাসে মেডিক্যাল ছাত্রীর ধর্ষণের জেরে মেয়েদের আন্দোলনে কেবল মেয়েদের উপর হিংসার অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক আদালত তৈরির অনুমোদন দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট। এ রাজ্যের চিত্রও সেই প্রয়োজনের ইঙ্গিতই দিচ্ছে। দার্জিলিঙে রয়েছে তিনটি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত। তবু মহিলাদের উপরে অপরাধ সংক্রান্ত পাঁচশোরও বেশি মামলার ফয়সালা হয়নি। কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, বারুইপুর ও আলিপুর আদালত সূত্রের খবর, বধূ-হত্যার প্রায় ১৫০টি মামলা বিভিন্ন কোর্টে ঝুলছে। বধূ নির্যাতনের প্রায় ৩ হাজার ৮০০টি, নারী পাচার সংক্রান্ত প্রায় ৯০টি এবং শ্লীলতাহানি সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা বিচারাধীন। নদিয়ার চাপড়ার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা আইনজীবী সামশুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “এই জেলায় মোট নথিভুক্ত অপরাধের ১০ শতাংশই মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত।” |
সমস্যা মেটাতে মহিলাদের উপরে নির্যাতনের বিচারের জন্যই কোনও নির্দিষ্ট ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গড়ার দাবি উঠছে। নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেন, “অভিজ্ঞতা বলছে, অভিযুক্তকে গ্রেফতার করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। দরকার মামলার দ্রুত ফয়সালা করা। কিন্তু পরিকাঠামোর সমস্যার জন্য দেরি হতে থাকে। আর তাতেই অভিযোগকারী উপরে চাপ বাড়তে থাকে।”
শুধু ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের বিচারের জন্যই ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গঠন করা উচিত, মনে করেন শাশ্বতী। প্রাক্তন আইনজীবী তাজ মহম্মদেরও কথায়, “ধর্ষণ এবং পারিবারিক হিংসার মামলাগুলি দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ আদালত তৈরি করা উচিত। শুধু ধর্ষণের বিচারের জন্যই তৈরি করা উচিত বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক আদালত।”
সুনন্দাদেবী অবশ্য পারিবারিক হিংসার দিকেও নির্দেশ করেন। তাঁর বক্তব্য, “মহকুমা শাসকও পারিবারিক সমস্যার নিরসন করতে পারেন, যদি তাঁকে সেই অধিকার দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারই পারে রাজ্য সরকারকে ট্রাইবুনাল গড়ে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দিতে। সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক স্তরে মীমাংসা হবে, আদালত অনেকটাই ভারমুক্ত হবে।”
রাজ্য সরকার সেই পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই করেছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “শুধু মহিলাদের জন্যই আদালত করা হবে এমন পরিকল্পনা রয়েছে। বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করবে মহিলারাই। যাতে নির্যাতিতা মহিলাদের পক্ষে আদালতে নিজেদের কথা বলতে সুবিধা হয়।” তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এই পরিকল্পনা নিয়েছেন।”
আইএএস অফিসার এবং জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য অনিতা অগ্নিহোত্রী বলেন, বিশেষ আদালত দরকার। কিন্তু দ্রুত নিষ্পত্তির উপর জোর দিতে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসন-বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে যথাযথ পদ্ধতি মেনে কাজ করার গুরুত্ব ভুললে চলবে না। এফআইআর দায়ের করাই একটি মেয়ের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। আজকাল আবার তাকে পাঠানো হয় ২০ কিলোমিটার দূরে মহিলা থানায়। অভিযোগ না নিলে পুলিশের শাস্তি হয় না। ঠিক সময়ে পাঠানো হয় না মেডিক্যাল পরীক্ষায়। ভাল পাবলিক প্রসিকিউটর না থাকলে পুলিশের কাছেও খালি হাতে যুদ্ধ করার মতো ব্যাপার দাঁড়িয়ে যায়। “তিন মাসে মামলা শেষ করতে গিয়ে মেয়েটি যদি সুবিচার না পায়, সেটাও খুব দুঃখের হবে,” বলেন তিনি। |