সংক্রমণ যত ছড়াচ্ছে, প্রতিরোধও তত জোরদার হচ্ছে। কোথাও প্রতিরোধের অস্ত্র স্কুল-কর্তৃপক্ষের অনড় মনোভাব। কোথাও আবার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী কিংবা পাড়ার লোকের সম্মিলিত প্রতিবাদ।
ভিতরে (অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ) ও বাইরের নানা চাপ সত্ত্বেও সন্তোষপুরের ঋষি অরবিন্দ বালিকা বিদ্যাপীঠ ২৯ জন অকৃতকার্য ছাত্রীকে পাশ না-করানোর সিদ্ধান্তেই অনড় থেকেছে। একই ভাবে বেহালার শিবরামপুর ননীলাল বিদ্যাপীঠ কিংবা হুগলির গুপ্তিপাড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ও ফেল করা ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের আব্দার মানেননি। শিবরামপুরের স্কুলটিতে উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে অনুত্তীর্ণদের পাশ করানো দাবি কর্তৃপক্ষ মানতে না-চাওয়ায় শুক্রবার শিক্ষকদের
স্কুলে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবাদে পাড়ার মানুষ এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়ান। অকৃতকার্যদের হয়ে যাঁরা গণ্ডগোল পাকাতে এসেছিল, তারা পালিয়ে যায়। গুপ্তিপাড়ার ঘটনাটিও অনেকটা তা-ই।
যে স্কুলের ঘটনাকে ‘নজির’ করে এই সব আন্দোলনের সূত্রপাত, কলকাতার সন্তোষপুরের সেই ঋষি অরবিন্দ বালিকা বিদ্যাপীঠে এ দিন পরিচালন সমিতির বৈঠক ছিল। কর্তৃপক্ষ অকৃতকার্য ছাত্রীদের সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল সব মহলে। বিশেষত যে সব স্কুল অকৃতকার্যদের জবরদস্তির কাছে মাথা নোয়ায়নি, তাদের অনেক কর্তা এ দিন সন্তোষপুরের খবর নিয়েছেন বারে বারে। কী হল বৈঠকে?
বৈঠকের পরে ঋষি অরবিন্দের প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতী ঘোষ জানান, অনেক বিবেচনা করেও উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে ফেল করা ২৯ জনকে পাশ করানো সম্ভব হয়নি। “উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, ওঁরা ফলাফলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছেন। তা মাথায় রেখেই অনুত্তীর্ণদের খাতা পরিচালন সমিতির সদস্যদের সামনে পুনর্মূল্যায়ন করেন শিক্ষিকারা।” বলেন তিনি। এবং প্রধান শিক্ষিকার কথায়, “টেস্টে টেনেটুনে পাশ করানো হলেও উচ্চ মাধ্যমিকে ওই ছাত্রীরা পাশ করতে পারবে না বুঝে আগের সিদ্ধান্তই বজায় রাখা হয়েছে। যারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তারা দু’-একটা বিষয়ে কম নম্বর পেয়ে থাকলে বিবেচনা করা যেত। কিন্তু প্রতিটা বিষয়েই তারা যে নম্বর পেয়েছে, তাতে ওদের পাশ করানো সম্ভব হয়নি। খুবই খুশি হতাম, যদি অন্য ছাত্রীদের মতো ওদেরও উত্তীর্ণ করে দিতে পারতাম।” |
পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে জেনে স্কুলের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের
সঙ্গে যোগাযোগ করি। সকলেই জানিয়ে দেন, কিছুতেই সিদ্ধান্ত বদলানো হবে না।
মদনমোহন মহাপাত্র
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শিবরামপুর ননীলাল বিদ্যাপীঠ |
|
|
সন্তোষপুরের স্কুলটিতে গত সোমবার দুপুরে শুরু হওয়া ঘেরাও-বিক্ষোভ বড় আকার নেয় মঙ্গলবার সকালে। সংসদের দুই কর্তা স্কুলে গিয়ে ঘেরাও তুললেও পরে টেস্টের খাতা, ট্যাবুলেশন শিট সংসদে নিয়ে যাওয়া হয়। স্কুলকে ফের টেস্ট নেওয়ার কথা বলেন সংসদ-কর্তারা। তত ক্ষণে অবশ্য সন্তোষপুর-সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্য জুড়ে। অকৃতকার্যদের পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে স্কুলে-স্কুলে দানা বেঁধেছে অশান্তি। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি হওয়া এই নতুন নৈরাজ্য নিয়ে আক্ষেপ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও। বৃহস্পতিবার শান্তিনিকেতনে তিনি বলেছেন, “আমি যদি মনে করি কম নম্বর পেলেও নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হবে, তা হলে সত্যিই আক্ষেপের কারণ আছে। চিন-কোরিয়া-জাপানে পরীক্ষা ব্যবস্থা আছে। এমনটা তো হতে পারে না যে, ওদের প্রয়োজন আছে, আর আমাদের নেই!”
বিষয়টিতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হওয়ায় অবশেষে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু হস্তক্ষেপ করেন। সংসদ জানিয়ে দেয়, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব স্কুলের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এই ‘বোধোদয়’ হতে যে সময়টা সংসদ নিয়েছে, নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট ছিল বলে শিক্ষাজগতে যুক্ত অনেকের অনুযোগ।
তবে আশার কথা, অন্যায্য দাবির মুখে অনেক স্কুলই নতি স্বীকার করেনি। ফলে বিক্ষোভের ঘটনাতেও ক্রমে লাগাম পড়েছে। এ দিন এমন বিক্ষোভ হয়েছে সাকুল্যে দু’টি। আর দুই ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষ স্কুল-কর্তৃপক্ষের পাশে দাঁড়ানোয় বিক্ষোভকারীরা হালে পানি পায়নি। কী রকম?
যেমন বেহালায়। বেলা বারোটা নাগাদ সরশুনার শিবরামপুর ননীলাল বিদ্যাপীঠে উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে ফেল করা এক দল ছাত্রী পাশের দাবিতে স্কুলের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দারা তালা ভেঙে শিক্ষক-অভিভাবকদের মুক্ত করেন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মদনমোহন মহাপাত্র জানান, উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে ২১ জন অকৃতকার্য হয়েছে। অধিকাংশ বিষয়ে তাদের নম্বর ৮-১০-১২। তারা খাতা দেখতে চাওয়ায় স্কুল-কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন, ২৭ ডিসেম্বর অভিভাবকদের উপস্থিতিতে খাতা দেখানো হবে। কিন্তু তার আগেই আন্দোলন শুরু করে অনুত্তীর্ণদের একাংশ। মদনমোহনবাবু বলেন, “পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে জেনে স্কুলের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সকলেই জানিয়ে দেন, কিছুতেই সিদ্ধান্ত বদলানো হবে না।”
তারই জেরে এ দিনের তালা-বিক্ষোভ, যার মোকাবিলায় এগিয়ে আসেন এলাকাবাসী-ই। স্থানীয় বাসিন্দা সম্রাট হাজরা বলেন, “ঘটনাটা দেখে কয়েক জন বন্ধু মিলে গেটের তালা ভেঙে আটক সবাইকে নিরাপদে বাইরে বার করে দিই।” তাতে ওঁদের পাল্টা হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ। সুদীপ্ত মণ্ডল, প্রতাপ দাসেরা বলেন, “বিক্ষোভকারীরা ফোন পেয়ে লোক ডেকেছিল। মোটর সাইকেলে চেপে জনা পনেরো ছেলে স্কুলের সামনে জড়ো হয়। ফেল করা একটা মেয়ে সম্রাটদের দেখিয়ে দেয়। ছেলেগুলো ওদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
এর পরে স্থানীয় মানুষ আর চুপ থাকেননি। একজোট হয়ে তাঁরা রুখে দাঁড়ান। বেগতিক দেখে হামলাকারীরা পালিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
একই ঢঙে এ দিন গুপ্তিপাড়ায় ‘আন্দোলন’ প্রতিহত হয়েছে। গুপ্তিপাড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে ১৮০ জনের মধ্যে ৩১ জন ছাত্রী পাশ করতে পারেনি। অকৃতকার্য কিছু ছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকেরা প্রধান শিক্ষিকার ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা মেয়েদের বাধ্য করেন তালা খুলতে, এবং শেষে গ্রামবাসীর চাপেই পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয় বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ এলেও তাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়নি।
মঙ্গলবার ইস্তক পরের পর পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করে এবং অবস্থান পাল্টে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ অবশ্য এ দিন নীরবই থেকেছে। সংসদের সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সংসদের আর কিছু বলার নেই। স্কুলের উপরেই এ সব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।” |