রাজ্যে ‘এক কোটি বেকার’ রয়েছে বলে জনসভায় মানলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেই সঙ্গে, ওই কর্মহীন যুবক-যুবতীর সরকারি চাকরির প্রত্যাশার চাপ কমাতে তাঁর দাওয়াই, বেসরকারি চাকরি।
বৃহস্পতিবার নদিয়ার তেহট্টে তৃণমূলের দলীয় জনসভার মঞ্চ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, “রাজ্যে এক কোটিরও বেশি বেকার আছেন।” তবে এ পরিসংখ্যানের প্রশ্নে কোনও সূত্র উল্লেখ করেননি তিনি।
এ দিন অবশ্য কর্মহীন ছেলেমেয়েদের আর সরকারি চাকরির ‘স্বপ্ন’ দেখাননি তিনি। মমতা বলেন, “শুধু সরকারি চাকরি নয়, বেসরকারি চাকরিরও খোঁজ করুন। এক বার দরখাস্ত করে চাকরি না পেলে ভেঙে পড়বেন না। যে যেখানে পারবেন, সরকারি-বেসরকারি, আবেদন করুন। তারপরে আমি দেখব।”
কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় কর্মী নিয়োগ মুখ্যমন্ত্রী কী করে দেখবেন? মুখ্যমন্ত্রীর ওই আশ্বাসের কথা শুনে রীতিমতো বিস্মিত রাজ্যের এক পরিচিত শিল্পোদ্যোগী। তাঁর প্রশ্ন, “এ বার কি বেসরকারি সংস্থায় চাকরির ক্ষেত্রেও সরকারি হস্তক্ষেপ দেখতে হবে?” আর, রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন বলছেন, “ইনফোসিস নেই, সিঙ্গুর নেই। ছেলেমেয়েরা দরখাস্ত করবে কার কাছে? শিল্প-কারখানা না-হলে চাকরির জায়গা কোথায়? সরকার যদি শিল্পের জন্য উদ্যোগী না হয়, তা হলে শুধু দরখাস্তই হবে। চাকরি হবে না!”
মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ হলেও রাজ্যের শিল্পমহলের একাংশ এ ধরনের মন্তব্যের সারবত্তা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, তা হলে কি সত্যিই রাজ্যে শিল্পায়নের অভাব কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও পড়তে শুরু করেছে? লগ্নি না আসার জন্যই কি চাকরির সুযোগ কমছে? সব থেকে বড় কথা এই ‘উপলব্ধি’ কি হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর? কারণ, তিনি তো এখনও শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে সরকারি ভাবে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তেই অনড়? শিল্পোদ্যোগীদের একাংশের মতে, সরকারের দাবি অনুযায়ী রাজ্যের আর্থিক কর্মকাণ্ড যদি ঠিকঠাক চলে তা হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়ার প্রশ্ন নেই। সে ক্ষেত্রে আবেদন করার পরে যদি কেউ যোগ্য বিবেচিত হন, তা হলে তিনি এমনিতেই চাকরি পাবেন। কিন্তু আর্থিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলে (শিল্পায়ন প্রক্রিয়া থমকে গেলে) চাকরির ক্ষেত্রও সঙ্কুচিত হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান হবে কী করে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা।
পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জন্য কী করে রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করবে, তা-ও তাঁরা বুঝতে পারছেন না। এক বণিকসভার কর্তা বলেন, “নিয়োগের প্রশ্নে বেসরকারি সংস্থায় প্রার্থীর যোগ্যতাই শেষ কথা। যদি বেসরকারি সংস্থার দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হয়, তা হলে যোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি দিতে তারা কালবিলম্ব করবে না। এ জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনই নেই।” তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এক চেনা মুখের মন্তব্য, “রাজ্যে ইনফোসিস এলে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি এমনিতেই হত। কিন্তু এখানে প্রকল্প না হলে সেই চাকরির সুযোগ কোথায়?
বেকার ছেলেমেয়েরা দরখাস্তই বা দেবেন কোথায়?”
প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের মতে, পশ্চিমবঙ্গের সামনে এগোনোর একমাত্র পথ শিল্পায়ন। কিন্তু তেমন কোনও দিশা বর্তমান সরকার দেখাতে পারছে না বলেই তাঁর দাবি। শিল্পের দিশা ছাড়া চাকরির আবেদন বা দরখাস্তে কোনও কাজ হবে না বলেই মন্তব্য করেন তিনি। সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “উনি (মুখ্যমন্ত্রী) তো নিজেই বলেছেন, নিলামে তুললেও এই সরকারকে কেউ কিনবে না! সেই সরকারের কাছে কেউ তা হলে আসবে কেন? সরকারের যেটুকু অর্থ আছে, উনি ক্লাবদের দিয়ে আর দানসত্র খুলে ব্যয় করছেন!”
প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মতে, “দেশের মধ্যে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে। এই সমস্যা দূর করতে হলে প্রধান কাজ শিল্প স্থাপন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, কেন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতা করে সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের দিকে এগোন। নইলে শিল্প হবে না, বেকার আরও বাড়বে!”
ঘটনাচক্রে, এ দিনই গুজরাতে সানন্দ বিধানসভা কেন্দ্রে জিতেছে কংগ্রেস। সিঙ্গুর থেকে টাটার ন্যানো প্রকল্প যেখানে চলে গিয়েছিল। সানন্দ-প্রসঙ্গ টেনে মানসবাবুর মন্তব্য, “কংগ্রেসের শিল্প ও বাণিজ্য নীতিকে মানুষ গ্রহণ করেছে। সানন্দে রাহুল গাঁধীর উপস্থিতিও কাজে লেগেছে। সিঙ্গুরেই টাটার কারখানা হতে পারত। এখনও সুযোগ আছে। শিল্পায়নের স্বার্থেই টাটাদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজ্য সরকার সুষ্ঠু সমাধান করার চেষ্টা করুক।”
কিন্তু সরকারের অনড় জমি-নীতি, শাসক দলের গোষ্ঠী-বিবাদ কিংবা বিভিন্ন জেলায় উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের জুলুমে অতিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গে বড় মাপের শিল্প প্রতিষ্ঠার আশু কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে শিল্পমহল। আর ভারী শিল্প না হলে একলপ্তে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগও যে নেই তা-ও তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন। |