‘আহত’ সিংহের গর্জন আর কাকে বলে!
টেস্ট দলে ‘ব্রাত্য’। বোর্ড প্রেসিডেন্টের এক ফোনে নির্বাচকরা নির্মম ভাবে ছেঁটে ফেলেছেন তাঁকে। ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’-কে ঘিরে দেশজোড়া আবেগে পাত্তা না দিয়ে। কিন্তু যুবরাজ সিংহ দেখিয়ে দিলেন, কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে আজও তিনি মহারাজ। কী ব্যাটে, কী বলে। ক্রুদ্ধ সিংহ-গর্জনে যে ভাবে কাঁপুনি ধরল ভারতে গত এক মাস ধরে চলা ব্রিটিশ-রাজে! পুণে-র সহারা সুব্রত রায় স্টেডিয়ামে আড়াই ওভার আগে ম্যাচ খতম, পাঁচ উইকেট হাতে রেখে। খুব সহজে, ক্রিকেট তার ক্ষুদ্র সংস্করণে ফিরতেই টিম ধোনির ‘দাদাগিরি’ও ফিরল। সেই চেনা মেজাজ, চেনা মস্তানি।
২০১১ আইপিএলে পুণেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গত বছর যখন এই মাঠ সৌরভের জন্য গলা ফাটিয়েছে, তখন সবে ক্যানসারকে হারিয়ে দেশে ফিরেছেন যুবি। তার পর পুণের বাইশ গজে এই প্রথম নামা। আর নেমেই ব্যাটে-বলে তাঁর সম্মোহনী-মন্ত্র জিতে নিল ‘ঘরের’ মাঠের মন। ইংল্যান্ড ইনিংসের ন’নম্বর ওভারে যখন যুবরাজের হাতে বল তুলে দিলেন ধোনি, দুই ইংরেজ অ্যালেক্স হেলস আর লিউক রাইট ধারাবাহিক ভাবে ওভার-পিছু নয়-দশ করে রান তুলছেন। স্টেডিয়াম জুড়ে জল্পনা—১৭০ হবে? না ১৮০? নিজের প্রথম ওভারে পাঁচ রান। আর দ্বিতীয় ওভারেই তুলে নিলেন রাইটের উইকেট। তিন নম্বর ওভারে ধোনিকে তাঁর জোড়া উপহারবিপজ্জনক হতে থাকা হেলস আর ইংরেজ অধিনায়ক ইয়ন মর্গ্যানের উইকেট। যুবরাজ ৪-০-১৯-৩। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর সেরা বোলিং গড়। ইংরেজ দুর্গে ফাটল ধরানোর ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’। |
যে ফাটলে আরও গোলাগুলি ছুড়লেন অশোক দিন্দা। দশ নম্বর ওভারের পরে দিন্দাকে একেবারে ১৯তম ওভারে ফিরিয়ে কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলেছিলেন ধোনি। আগের ওভারেই ১৫ রান দিয়ে ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফিরিয়ে দিয়েছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ডেথ ওভারে পেসারের বল করা এমনিতেই বড় ফাটকা। হয় চলবে, না হলে নয়। দিন্দা চললেন না, নৈছনপুর এক্সপ্রেসের মতোই ছুটলেন। টি-টোয়েন্টি দুনিয়ার ও রকম গুরুত্বপূর্ণ ওভারে দু-দুটো উইকেট! খরচ মাত্র দু’রান। ওভারের প্রথম বলেই ফেরালেন সমিত পটেলকে। যিনি ২২ বলে ২৪ রান করে ইংল্যান্ডকে বড় স্কোরের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। চতুর্থ বলে টিম ব্রেসনানের উইকেট। ৩-০-১৮-২ বোলিং গড় নিয়ে দিন্দা ওয়াংখেড়ের প্রথম এগারোয় মোটামুটি নিশ্চিত। বারবার টেস্ট স্কোয়াডে ডাক পেয়েও টেস্ট ক্যাপ অধরা থাকার হতাশাও হয়তো কিছুটা কমবে।
বোলিংয়ে যেমন ভাঙলেন, ব্যাটিংয়ে আবার তেমনই গড়লেন যুবরাজ। শিশির-ফ্যাক্টরের কথা মাথায় রেখে টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন ধোনি। পরের দিকে ব্যাট করা সহজ হবে বলে। কতটা সহজ, দেখিয়ে দিলেন যুবরাজ। ক্রিজে এসেই প্রথম বলটা বাউন্ডারির বাইরে পাঠানো দিয়ে শুরু। পরে অনামী স্পিনার ড্যানি ব্রিগসের ওভারে বাউন্ডারির হ্যাটট্রিকছয়, চার, ছয়। ২০ বলে ৩৮ রানের ‘দে ঘুমাকে’ ইনিংস খেলে যখন ডাগআউটে ফিরছেন, গ্যালারির গর্জনে তখন দুটোই অক্ষর‘ইউ-ভি, ইউ-ভি’!
জয়ের রানটা যদিও এল ধোনির ব্যাট থেকে। অনায়াসে, স্বস্তির মেজাজে। হবেই। এটা তো টেস্টের অন্ধগলি নয়। ইয়ে টি-টোয়েন্টি হ্যায় বস! এই পাড়ায় ধোনিই ‘মস্তান’। নিজের মহল্লায় তিনি মস্তানি দেখাবেন না তো কে দেখাবে?
|
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ইংল্যান্ড ১৫৭-৬ (হেলস ৫৬, যুবরাজ ৩-১৯, দিন্দা ২-১৮)।
ভারত ১৫৮-৫ ১৭.৫ ওভারে (যুবরাজ ৩৮, ধোনি ২৬ ন.আ.)।
|
নির্যাতিতাকে পুরস্কার উৎসর্গ যুবরাজের
প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত • পুণে |
‘মৃত্যুঞ্জয়ী’র হৃদয় বোধহয় এমনই হয়! নাগপুর টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে টি-টোয়েন্টিতে টিমকে জেতানোর নায়ক যুবরাজ সিংহের গলায় তিক্ততা নেই। নিজেকে প্রমাণ করার সন্তুষ্টি নেই। থাকল মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা এক তরুণীর প্রতি গভীর সমবেদনা। নিজের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার যুবরাজ উৎসর্গ করলেন দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডে আক্রান্ত সেই ২৩ বছরের ছাত্রীকে, যাঁর জন্য গত কয়েক দিন ধরে প্রার্থনা করছে গোটা দেশ। ম্যাচ জিতে উঠে এ দিন যুবরাজ বলে দিলেন, “ঘটনাটা ভীষণ দুঃখজনক। শুধু আমি না, গোটা টিম ওর জন্য প্রার্থনা করছে। জানি না ও এখন কী অবস্থায় আছে। ম্যাচের সেরার পুরস্কার ওকে আর ওর মা-বাবাকে উৎসর্গ করলাম। আশা করব এ রকম ঘটনা আর কোনও দিন ঘটবে না।” যুবরাজের জীবন-দর্শন যে কতটা পাল্টে গিয়েছে, তা আরও এক বার ধরা পড়ল বৃহস্পতিবার। যখন টেস্ট দল থেকে বাদ পড়া নিয়ে তিনি বলে দিলেন, “এক বছর আগে আমি শয্যাশায়ী ছিলাম। যেখান থেকে আমি ফিরে এসেছি, বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে সৌভাগ্য। টেস্ট, ওয়ান ডে না টি-টোয়েন্টি কী খেলছি সেটা দেখি না। দেশের হয়ে খেলতে পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার।” |