আমার ব্রোঞ্জটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন
ন্ধের দিকে সাধারণ একটা মেডিক্যাল চেকআপ করাতে মুম্বইয়ে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর চেম্বারে যাচ্ছিলাম। রাস্তাতেই বাবার ফোন পেলাম। ক্লডিয়াস আঙ্কল আর নেই!
কাল-পরশুর মধ্যেই বেঙ্গালুরু যাব খুব পুরোনো এক বন্ধুর বিয়ে। তার পর চেন্নাই ওপেন। নতুন মরসুমের প্রথম টুর্নামেন্ট। সব মিলিয়ে মনটা ফুরফুরে ছিল। বাবার ফোন পেয়ে নিমেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল। লেসলি ক্লডিয়াস নিয়ে পর পর অনেক ছবি চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
বাবা ভেস পেজের হাত ধরে খুব ছোট বয়সে মোহনবাগান মাঠে ক্লডিয়াসকে প্রথম সামনাসামনি দেখা...বড় হয়ে ডালহৌসি ইনস্টিটিউট আর ক্যালকাটা রেঞ্জার্স ক্লাবে অসংখ্য বার তাঁর সঙ্গে গল্প করা...ওঁর বিয়ারের অফার আমার বিনম্র ভাবে ফেরত দেওয়া (তাঁর অসাধারণ অলিম্পিক-কীর্তির কথা ভেবে বিয়ারের অফার নিতামই বা কী করে!)...আটলান্টা অলিম্পিক থেকে ব্রোঞ্জ জিতে ফেরার পর তাঁকে সেটা বাড়িতে দেখাতে গিয়ে তাঁর আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া...আমার অলিম্পিক পদকটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলা। বাবা মিউনিখ অলিম্পিকে হকিতে ব্রোঞ্জ জিতে ফেরার পরেও নাকি ক্লডিয়াস বাবাকে জড়িয়েও ওই রকম আদর করেছিলেন। লেসলি স্যর শুধু বাবার কাছে নয়, আমাদের পরিবারের কাছেই গুরুজনের মতো ছিলেন। শান্ত, নম্র স্বভাবের মানুষ। এমনকী কথাও বলতেন নিচু গলায়। আমার তাঁর খেলা দেখার কোনও প্রশ্ন ছিল না। তবে বাবার কাছে শুনেছি, খেলার মাঠেও যে কোনও পরিস্থিতিতে ঠান্ডা থাকতেন। লেসলি ক্লডিয়াসকে কেউ কোনও দিন হকি স্টিক কাঁধের ওপর তুলতে দেখেনি!
স্বর্ণ যুগের চার মূর্তি। প্যাট জেনসেন, কে ডি সিংহ বাবু,
কেশব দত্ত এবং লেসলি ক্লডিয়াস।—ফাইল চিত্র
তাঁর খেলা কোনও দিন না-দেখলেও নির্দ্বিধায় এখানে লিখছি, ক্লডিয়াসই ভারতের সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান। সব খেলা মিলিয়ে। অলিম্পিক পদক জেতা তো বটেই, অলিম্পিকে অংশ নিতে পারাটাই বিশ্বের যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছে বিরাট প্রাপ্তি। বিশাল কৃতিত্ব। সেখানে কি না অলিম্পিকে ক্লডিয়াসের তিন-তিনটে সোনা আর একটা রুপোর পদক! আমার নিজের একটা অলিম্পিক ব্রোঞ্জ পদক জেতার জন্যই গর্বের শেষ নেই। কিন্তু যখন ক্লডিয়াসের অলিম্পিক পারফরম্যান্সের কথা ভাবি, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ি। ভারতীয় হকির স্বর্ণযুগে বারো বছরে টানা চারটে অলিম্পিক থেকে তিনি চারটে পদক জিতেছিলেন। যখন সেই দলটার প্রত্যেকেই বিশ্বের অন্যতম সেরা প্লেয়ার ছিলেন। এটা মাথায় রাখলেই বোঝা যায়, ক্লডিয়াস তা হলে কী বিরাট মাপের, অসাধারণ প্লেয়ার ছিলেন। আমার টেনিস জীবনে অনেক রোলমডেল আছে। এবং তাঁরা যে শুধু টেনিস জগতের মানুষ তাও না। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা যেমন আমার রোলমডেল, তেমনই আমার বাবা ভেস পেজ। কিংবা ক্রিকেটের সৌরভ, ফুটবলের চুনীদা। এঁদের প্রত্যেককে আমি তাঁদের পারফরম্যান্স, কীর্তির জন্য শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ক্লডিয়াস আমার চোখে গোটা ভারতীয় খেলাধুলোরই একজন আইকন।
এক এক সময় মনে হয়, আমি যদি টেনিস প্লেয়ার না হয়ে হকি খেলতাম, কাকে অনুকরণ করতাম? আমার বাবাকে, নাকি আমার শহর কলকাতাতেই থাকা আধুনিক ভারতীয় হকির কিংবদন্তি ক্লডিয়াসকে? এর উত্তর আমার কাছে আজও অজানা। আমার বাবা পদকজয়ী হকি অলিম্পিয়ান। আমার ছোটবেলার হিরো। শুধু হকি নয়, ফুটবল, রাগবি, ক্রিকেটসবেতেই বাবা আমার ছোটবেলার নায়ক। আমার মতোই বাবা সব খেলা খেলতে পাগল ছিলেন।
এ রকম একটা মন খারাপ করা দিনে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু মজার একটা প্রশ্ন করলেন। নরেশ কুমারের জায়গায় ক্লডিয়াস ডেভিস কাপ টিমের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন থাকলে আমি আরও বেশি মোটিভেটেড হতাম কি না? লেসলি-নরেশ, দু’জনেই নিজেদের খেলায় দুর্ধর্ষ প্লেয়ার। নিজেদের খেলাটা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। দুর্দান্ত মোটিভেটর। বাবার মুখে শোনা একটা গল্প বলে শেষ করছি। চৌষট্টিতে ক্লডিয়াস বেঙ্গল হকি টিমের নির্বাচক-কাম-কোচ ছিলেন। জাভেরিয়ানদের হয়ে মাত্র ১৯ বছরের ভেস পেজের খেলা দেখে তাঁকে সরাসরি বাংলা দলে নিয়েছিলেন ক্লডিয়াস। প্রথম দু’টো ম্যাচে বাবা খারাপ খেলা সত্ত্বেও কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে তাঁকে মাঠে নামান। আর বাবাও মাঝমাঠে পিটার, হরিপাল কৌশিক, বান্দু পাটিলের মতো দিকপালদের রুখে দিয়েছিলেন।
নিজের মনের ভেতরের কথাকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতেন ক্লডিয়াস। আর সবচেয়ে পছন্দ ছিল সব কিছু সিম্পল ভাবে করা। আমাদের দেশের খেলাধুলো থেকে জীবনসবেতেই এই মুহূর্তে যে দুটো জিনিস সবচেয়ে দুর্লভ!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.